নতুন ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) কার্যকরের আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়ার সংখ্যা হঠাৎ অনেক বেড়ে যেতে দেখা গেছে।
রাজউকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থা থেকে সাধারণত বছরে গড়ে চার হাজারের মতো ভবন নির্মাণের অনুমোদন হয়। কিন্তু নতুন ড্যাপ কার্যকরের আগে হঠাৎ আবেদনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ফলে অনুমোদনের সংখ্যাও বেড়েছে।
আবেদনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে নতুন ড্যাপ দ্রুত কার্যকর হতে যাচ্ছে, এমন চিন্তা ভবনমালিকদের মধ্যে কাজ করেছে বলে মনে করেন রাজউকের কর্মকর্তারা।
২৩ আগস্ট নতুন ড্যাপের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এটি ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
নতুন এ ড্যাপের খসড়া ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশ করা হয়। খসড়ায় রাজউক এলাকায় জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে আবাসিক ভবনের উচ্চতা সর্বোচ্চ আটতলা নির্ধারণ করা হয়। মূলত এর পর থেকেই ভবনের নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন বেড়ে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ভবনমালিকই উঁচু আবাসিক ভবন বানাতে চান। নতুন ড্যাপ কার্যকর হলে তাঁরা প্রত্যাশা অনুযায়ী উঁচু ভবন নির্মাণ করতে পারবেন না, এমন আশঙ্কা করেছিলেন ভবনমালিকেরা। তাই তাঁরা দ্রুত ভবন নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন করেছিলেন, যাতে নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগেই আশানুরূপ উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায়।
নতুন ড্যাপ প্রণয়নের জন্য ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়ার সংখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় প্রতিবছর গড়ে চার হাজারের মতো ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬১২টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
করোনাকালে দেশে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ ছিল। তা সত্ত্বেও রাজউকে ভবন নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
২০২১ সালে ১০ হাজার ৩২টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই ছিল আবাসিক ভবন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৫৬টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক।
নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ায় এখন আবার পরিস্থিতি আগের মতো হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপনে ২০১০ সালে পাস হওয়া ড্যাপ রহিত করা হয়। তবে ২০১০ সালের ড্যাপের আলোকে যেসব কার্যক্রম হয়েছে, তা বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবন নির্মাণের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে।
ড্যাপ মূলত একটি মহাপরিকল্পনা। এতে পুরো রাজউক এলাকায় ভূমি ব্যবহারসহ পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য নানা কৌশলের কথা বলা হয়। এসব কৌশলের পাশাপাশি ড্যাপে উল্লেখিত ভূমি ব্যবহার ধরেই রাজউকের ভবন নির্মাণসংক্রান্ত অন্য বিধিমালা হয়।
এ ছাড়া ভবন নির্মাণ অনুমোদনের জন্য কেউ ছাড়পত্রের আবেদন করলে শুরুতে ড্যাপ–সংশ্লিষ্ট জমির শ্রেণি যাচাই করে দেখা হয়। ফলে ড্যাপে কোনো এলাকায় বা প্লটে আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা আটতলা ধরা হলে সেখানে বৈধভাবে আর তলা বাড়ানো সম্ভব ছিল না।
নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের কৌশল বাতিল করা হয়েছে। তবে এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত এফএআরের মাধ্যমে একটি প্লটে কত আয়তন বা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা হবে, তা নির্ধারণ করা হয়।
যেসব এলাকায় নাগরিক পরিষেবার মান ভালো, পার্ক বা উন্মুক্ত স্থান আছে, প্লটের পাশে প্রশস্ত রাস্তা আছে, সেসব এলাকায় এফএআরের মান বেশি ধরা হয়েছে।
আর যেসব এলাকায় রাস্তা সরু ও নাগরিক সেবার মান তুলনামূলকভাবে খারাপ, সেসব এলাকায় এফএআরের মান কম ধরা হয়েছে।
এলাকাভিত্তিক এফএআর ভিন্ন হওয়ায় প্লট ও পাশের রাস্তার আয়তন একই হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকা ও গুলশানে একই উচ্চতার ভবন এখন আর নির্মাণ করা যাবে না। আগে রাস্তা ও প্লটের আকার একই হলে দুই এলাকাতেই সমান আয়তন বা উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতায় হেরফের হলেও তা কার্যকরে আগে যাঁরা অনুমোদন নিয়েছেন, তাঁরা অনুমোদনপত্র ও নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগে যাঁরা নির্মাণ অনুমোদন নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ড্যাপে এলাকাভিত্তিক এফএআর নির্ধারণের কারণে কিছু এলাকায় ভবনের উচ্চতা অনেক কমে যাবে, কিছু এলাকায় সামান্য কমবে। তবে ড্যাপে যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে তা ঢাকা শহরের জন্য ইতিবাচক। এটি রাজউক যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করলে ঢাকা শহর টেকসই ও বাসযোগ্য হবে।