শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ
শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ

সাঈদ-মুগ্ধদের মতো সাহসী হতে চেয়েছিল আহনাফ, হয়েছেও তাই

শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। সে তার পরিবারের সদস্যদের বলত, বড় হয়ে এমন কিছু করবে, যার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে গর্ব করবেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে নিহত হয় আহনাফ। তাকে নিয়ে এখন গর্বিত পরিবারের সদস্যরা। তবে আহনাফের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এভাবে তাঁরা গর্বিত হতে চাননি।

রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আহনাফ। ২০২৫ সালে তার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই আহনাফ সোচ্চার ছিল। আন্দোলনে অংশ নিয়ে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে আহত হয়ে সে একবার বাসায় ফিরেছিল।

আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী ও ছোট ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ

আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে আহনাফ তার মা আর খালাকে বলত, ‘তোমাদের মতো ভিতু মা-খালাদের জন্য ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে তোমাদের মতো মা-খালারা থাকলে দেশ আর স্বাধীন হতো না।’

আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী ও খালা নাজিয়া আহমেদ। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে যেতে বাধা দিলেই আহনাফ বলত, সে সাঈদ-মুগ্ধ ভাইদের মতো সাহসী হতে চায়। তাঁদের মতো কিছু হলে তাঁরা গর্ব করে বলতে পারবেন, ‘আমরা আহনাফের মা-খালা’। শেষ পর্যন্ত আহনাফ হয়েছেও তাই।

কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আর ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ।

গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ায় আহনাফের বাসায় কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ‘ওই যে ওর গিটার, ওই যে ওর পড়ার টেবিল’—এভাবেই দেখাচ্ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। পড়ার টেবিলটি বেশ গুছিয়ে রেখেছিল আহনাফ, তা সেভাবেই আছে।

আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ ও ছোট ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ

আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ছেলেটা চলে গেছে, কিন্তু ঘরে রেখে গেছে অনেক স্মৃতি।’

খাটের নিচ থেকে ছেলের হলুদ জুতা বের করে দেখান বাবা। বলেন, ‘এই জুতা পায়ে দিয়ে আহনাফ ফুটবল খেলত। আর গিটারটা ছিল ওর প্রাণ।’

আহনাফের ছোট ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, তার বড় ভাই আর নেই। ভাইয়ের গিটার বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছিল সে। গিটারে কেউ হাত দিলেই সে দৌড়ে গিয়ে দেখছিল, সেটি ঠিক আছে কি না।

ছোট ভাই ইফতেখারকে আহনাফ বলেছিল, সে তার সবচেয়ে প্রিয় গিটারটি তাকে (ইফতেখার) দিয়ে দেবে। আহনাফ চলে যাওয়ায় এখন গিটারের দিকে বেশি সময় তাকাতেও পারছে না ইফতেখার।

পরিবারের সদস্যরা জানালেন, বড় ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে ইফতেখার খাওয়াদাওয়া প্রায় বাদ দিয়েছে। ভাইয়ের টি–শার্ট গায়ে দিয়ে বসে থাকছে। পাল্টাতে বললে ভাইয়ের অন্য টি–শার্ট গায়ে দিচ্ছে।

আহনাফ ঘরে রেখে গেছে অনেক স্মৃতি

‘টেনশন কোরো না’

আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী বললেন, বাইরের পরিস্থিতি ভালো না থাকায় ৪ আগস্ট সকাল থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলেন তিনি। তবে ছেলে কিছুতেই নিষেধ মানতে চাচ্ছিল না। বারবার বলছিল, সে যাবেই। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আহনাফ। তখন সাফাত সিদ্দিকী বলেছিলেন, তিনিও সঙ্গে যাবেন। কিন্তু ছেলে দ্রুত নিচে নেমে যায়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফোন দিলে আহনাফের জানায়, সে মিরপুর ১০ নম্বরে আছে।

সন্তানহারা এই মা বললেন, ‘ছেলেকে ফোন দিলে সে বলে, আম্মু আমি ১০ নম্বরে ভালো আছি। টেনশন কোরো না। এই শেষ কথা। এরপর ছেলে আর ফোন ধরেনি। একসময় ছেলের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফোন আর বাজে না। এরপর ছেলে যেসব জায়গায় খেলে, সেসব জায়গায় গিয়ে খুঁজি। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। কেউ কিছু বলতে পারে না। এরপর অচেনা একটা নম্বর থেকে ফোন আসে।’

ফোন পেয়ে সাফাত সিদ্দিকীসহ পরিবারের সদস্যরা মিরপুরের ইসলামিয়া হাসপাতালে যান। সেখানে একজন আন্দোলনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ছবি দেখান। ছবি দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন, এ তো আহনাফ!

আহনাফের জুতা

ইসলামিয়া হাসপাতাল থেকে সাফাত সিদ্দিকীদের শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে মর্গে আহনাফের লাশ পান পরিবারের সদস্যরা।

সাফাত সিদ্দিকী বললেন, আন্দোলনকারীদের কেউ বড় একটি জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে হয়তো আহনাফকে হাসপাতালে এনেছিলেন। তার লাশের সঙ্গে সেই পতাকাটাও ছিল। আহনাফের পেটের কাছে গুলি লেগেছিল। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাদির কবরে আহনাফকে কবর দেওয়া হয়।

আহনাফের মোবাইলটি আর পাননি তার পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, তা তো আহনাফ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। সেই আহনাফই তো নেই। তাঁরা আহনাফের লাশের ময়নাতদন্ত চাননি। কারও কাছে বিচারও চাননি। শুধু ওপরওয়ালাকে কাছে বিচার দিয়ে রেখেছেন।

বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘ছেলে আন্দোলনে যেত বলে আমরা ভয় পেতাম। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো ভয়ডর ছিল না। মা-খালাদের ভিতু বলত। ছেলেকে আটকাতে পারলাম না। মর্গে গিয়ে ছেলের লাশ পেলাম।’

আহনাফের পড়ার টেবিল

কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয়ে আহনাফ বলেছিল, ভবিষ্যতে সে চাকরি করবে না, ব্যবসা করবে। পাশাপাশি গানের ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে চেয়েছিল সে।

৪ আগস্ট বাসায় থাকাকালে আহনাফ তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বসে মোবাইলে গেম খেলেছে। দুই ভাই খুনসুটিও করেছে। মাকে গিটার বাজিয়ে শুনিয়েছে। বন্ধুদের ফোন এলে দুপুরে খাবার খেয়ে বের হয়েছিল সে।

মা সাফাত সিদ্দিকী বলছিলেন, আহনাফ কখনো নিজের হাতে খেত না। তাকে তিনি সব সময় খাইয়ে দিতেন। সেদিন দুপুরেও ছেলেকে খাইয়ে দেন। পোলাও, রোস্টসহ বাইরের খাবার খেতে পছন্দ করত সে। তার তেমন কোনো আবদার ছিল না। এসএসসি পাসের পর আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের টাকা দিয়ে সে গিটার কিনেছিল। নিজের টিফিনের টাকা থেকে গিটারের জন্য একটি বেল্ট কিনেছিল। ইউটিউবের ভিডিও দেখে নিজে নিজে গিটার বাজানো শিখেছিল।

আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ বললেন, আন্দোলনে অনেক শিশু মারা গেছে। এই শিশুদের জন্য তিনি সব সময় দোয়া করতেন। এখন নিজেই সন্তানহারা হলেন।

আহনাফের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা সাফাত সিদ্দিকী

নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার সন্তানও চলে যাবে, তা তো কখনো ভাবিনি। আমাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে এখন শুধু সুন্দর একটা দেশ চাই।’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় গত ১ জুলাই। ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গত ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সংঘাত-সহিংসতায় ৩৩১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২৪৮ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে ২৬ দিনে মোট ৫৭৯ জন নিহত হয়েছেন।

এই আন্দোলন ঘিরে সব মিলিয়ে কত শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা যখন ২১২ জন ছিল, তখন প্রথম আলো ১৭৫ জনের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে। সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২২ জন শিশু-কিশোর। এ তালিকায় তিন বছরের শিশুও আছে।

আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী, বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ ও ছোট ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ

আহনাফের একমাত্র খালা নাজিয়া আহমেদ বললেন, ‘আহনাফকে বলতাম, তুই তো একটা মাকাল ফল। তখন সে বলত, আমি এমন কিছু করব যে আমার নাম স্বর্ণের অক্ষরে লেখা থাকবে। তোমরা আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। আমার জন্য তোমাদের সবাই চিনবে। এখন আহনাফকে নিয়ে আমরা গর্ব করছি। কিন্তু এভাবে গর্ব করতে চাইনি। এত আহনাফ জীবন দিল, কিন্তু দেশে তো এখনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি আসেনি। দেশে শান্তি ফিরে এলে আহনাফদের জীবন দেওয়া সার্থক হবে। যে আহনাফরা মারা গেল, তাদের নাম যেন স্বর্ণের অক্ষরে লেখা থাকে।’

আহনাফ স্থানীয় মডেল একাডেমিতে পড়াশোনা করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের খেলার মাঠের নামকরণ আহনাফের নামে করেছেন। এলাকার একজন জানালেন, আহনাফের বাসার সামনের সড়কটি তার নামে নামকরণের চিন্তাভাবনা চলছে।