মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলাকালে ভোগান্তি এড়াতে মিরপুর এলাকার বাসা বদল করে অন্য এলাকায় চলে যান তাইজুল ইসলাম। সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ কর্মকর্তাকে দেখা গেল আবারও পশ্চিম কাজীপাড়া এলাকায় বাসা খুঁজছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কাজীপাড়া এলাকা ছেড়েছিলাম উপায় না দেখে। এখন যেহেতু মেট্রোরেল চালু হয়েছে, রাস্তাও ঠিক হয়ে গেছে, তাই আবার এই দিকেই বাসা খুঁজছি।
তবে বাসাভাড়া বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তাইজুল ইসলাম বলেন, ‘দুই কক্ষের কিছু বাসা আগে ৯-১০ হাজারের মধ্যে পাওয়া যেত। এখন সেগুলো ১২-১৩ হাজার টাকা চাইছে।’
পশ্চিম কাজীপাড়ায় লন্ড্রির দোকান চালানোর পাশাপাশি একটি বাড়ির তত্ত্বাবধানকারীর দায়িত্বে আছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওই বাড়িতে তিন কক্ষের (ড্রয়িং-ডাইনিং, দুটি শৌচাগার লিফট ছাড়া) বাসার ভাড়া ১৬ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল আলাদা।
শরিফুল ইসলাম বলেন, ওই বাড়িতে প্রায় পাঁচ বছর আগেও ভাড়া নেওয়া হতো ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। করোনার পরে ২০২১ সালে মালিক ভাড়া বাড়িয়ে ১৪-১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করেন। সর্বশেষ জানুয়ারিতে ভাড়া ১৬ হাজার টাকা করা হয়।
শরিফুল যে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করেন, সেটিরও ভাড়া বাড়াতে চেয়েছিলেন মালিক। তিনি বলেন, তিন বছরের চুক্তিতে দোকান নিয়েছি। ভাড়া দিতে হয় সাত হাজার টাকা। মালিক ৯ হাজার টাকা ভাড়া দিতে বলেছিলেন। তবে আপাতত চুক্তির কারণে বাড়াতে পারেননি।
এসব এলাকার একাধিক বাসিন্দা ও ভাড়াটে বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকেই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় বাসাভাড়া নেওয়ার চাহিদা বেড়ে যায়। এমনকি প্রকল্পের কাজে দুর্ভোগ থাকায় যাঁরা অন্য এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাও আবার মিরপুরে বাসা নিচ্ছেন। এতে বাসা ভাড়াও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মেট্রোরেলের স্টেশনসংলগ্ন এলাকা শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১ এবং পল্লবীতে (মিরপুর-১২) ভাড়া আগের চেয়ে বেড়েছে।
মেট্রোরেলের কারণে এমনিতেই মিরপুরের সব এলাকার বাসাভাড়া বাইড়া গেছে। বাজারে সব জিনিসপত্রের ম্যালা দাম। তাই স্যারও (বাড়ি মালিক) ভাড়া ১ হাজার টাকা বাড়াই দিছেআবদুল জলিল, একটি বাসার নিরাপত্তা প্রহরী
রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরে পল্লবী এলাকার সি ব্লকে হোসনা মঞ্জিল নামেন একটি ছয়তলা বাড়ির সবার ওপরের তলায় দুটি কক্ষের বাসা ভাড়া দিতে মালিক বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছেন। মেট্রোরেলের পল্লবী স্টেশন থেকে বাড়িটির দূরত্ব ৩০০ মিটারের কম। বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী আবদুল জলিল জানালেন, বাসা ভাড়া প্রতি মাসে ১১ হাজার টাকা। সঙ্গে সেবা ফি (সার্ভিস চার্জ) বাবদ এক হাজার টাকা আর পানির বিল বাবদ আরও ৬০০ টাকা দিতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎসেবা প্রিপেইড সিস্টেম। এর বিল ভাড়াটের নিজের।
দুই কক্ষের বাসার এত ভাড়া কেন, জানতে চাইলে আবদুল জলিল বললেন, ‘মেট্রোরেলের কারণে এমনিতেই মিরপুরের সব এলাকার বাসাভাড়া বাইড়া গেছে। বাজারে সব জিনিসপত্রের ম্যালা দাম। তাই স্যারও (বাড়ি মালিক) ভাড়া ১ হাজার টাকা বাড়াই দিছে।’
একইভাবে বাসাভাড়া বেড়েছে মেট্রোরেলের ১১ নম্বরের স্টেশনসংলগ্ন সেতারাস ড্রিম নামের একটি ভবনেও। ১৮ তলার এই ভবনের ১১ তলায় একটি ফ্ল্যাটের জন্য ভাড়া চাওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে লিফট, দারোয়ান, গ্যারেজ ও ময়লার জন্য সার্ভিস চার্জ দিতে হবে ৫ হাজার ৫৫০ টাকা। আর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল ভাড়াটের। আগের ভাড়াটে ওই বাসার জন্য ১৯ হাজার টাকা ভাড়া দিতেন বলে জানালেন ভবনটির নিরাপত্তা প্রহরী মোজাম্মেল হক।
বাড়িটির অবস্থান বেগম রোকেয়া সরণির পাশেই। বাসাটি ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের। ভাড়া বাড়ার কারণ জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কী কারণে ভাড়া বাড়ছে, এটা মালিক বলতে পারবেন।’
বিষয়টি সব সময় লক্ষ করছি যে কোনো জায়গায় যখনই সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প হয়, তখন সেখানে জমির দাম, বাড়িভাড়া এসব বৃদ্ধি পায়। কারণ, ওই সব এলাকায় জায়গাজমি কেনা বা খোঁজার হার বেড়ে যায়। বিষয়টি এখন একপ্রকার প্যাটার্নে (নিয়মিত ঘটনায়) পরিণত হয়েছেগোলাম রহমান,ক্যাবের সভাপতি
অনলাইনে পছন্দের বাসা বা ফ্ল্যাট খুঁজে বের করা, দেখা, এর দাম এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিপ্রপার্টিতে। বিপ্রপার্টি কর্তৃপক্ষের তথ্যও বলছে মিরপুরে বাসাভাড়া নেওয়ার চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, এলাকাভিত্তিক চাহিদার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি এখন মিরপুরে, ২৪ শতাংশ। আর এরপর রয়েছে উত্তরা, ১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে ১৭ শতাংশ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৪ শতাংশ এবং মোহাম্মদপুরে চাহিদা রয়েছে ১১ শতাংশ।
বিপ্রপার্টির বিপণন ও জনসংযোগ শাখার উপব্যবস্থাপক (ডেপুটি ম্যানেজার) ইমাদ ফায়েদ আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে মিরপুর এলাকা। ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি বর্গফুট বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৬৬৯ টাকায়। এর আগে ছিল ৫ হাজার ২১৯ টাকা। বৃদ্ধির এই হারের পেছনে রয়েছে রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানী ও উত্তরা এলাকা। আর মিরপুরের চেয়ে এগিয়ে আছে পর্যায়ক্রমে ধানমন্ডি, রামপুরা, মোহাম্মদপুর ও গুলশান। এসব এলাকায় ৩ শতাংশ থেকে শুরু করে ৯ শতাংশ পর্যন্ত ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত কয়েক মাসে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় দুই বা তিন কক্ষের বাসাভাড়া ৫০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মিরপুরের অনেক এলাকায় টিনের ছাউনির বা একতলা-দোতলা বাড়িতে এক কক্ষের বাসাভাড়া পাওয়া যায়। এসব জায়গায় রান্নার কাজ, স্নান ও শৌচাগার ভাড়াটেদের ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। এমন বাসার ভাড়া বেড়েছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
বেগম রোকেয়া সরণি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার ভেতরে এক কক্ষের বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন এমন কয়েকজন নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টিনের ছাউনির ঘরে ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে। আর ছাদ ঢালাই হওয়া ভবনের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
পর্বতা এলাকার একটি দোতলা বাড়িতে ১৬টি এক কক্ষের বাসা রয়েছে। সেখানে বাড়ির মালিকের হয়ে বাড়িটি দেখভালের কাজ করেন সাইদুল হক। তিনি বলেন, গত জানুয়ারি থেকে কক্ষের আকার (বড়-ছোট) অনুযায়ী ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এর আগে ভাড়া ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সব সময় লক্ষ করছি যে কোনো জায়গায় যখনই সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প হয়, তখন সেখানে জমির দাম, বাড়িভাড়া এসব বৃদ্ধি পায়। কারণ, ওই সব এলাকায় জায়গাজমি কেনা বা খোঁজার হার বেড়ে যায়। বিষয়টি এখন একপ্রকার প্যাটার্নে (নিয়মিত ঘটনায়) পরিণত হয়েছে।