ঢাকাতেও এখন ‘গ্রামীণ সড়ক’

তিন বছরে ২৪৩ কোটি টাকা খরচের পরও পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ সড়ক বেহাল।

ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন মধ্যবাড্ডা বাজার সড়ক এটি। চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় কর্তৃপক্ষ সড়কটি সংস্কারের জন্য খুঁড়ে নালা নির্মাণের কাজ করছে। দুই মাস ধরে চলছে এই দশা। গতকাল দুপুরে

‘কখন ট্রাক উল্টে যায়, এই ভয়ে থাকি। গ্রামের রাস্তাও এত খারাপ না’—ট্রাকচালক মুরাদ হোসেন শুরু করলেন এভাবেই। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত বুধবার দুপুরে।

ট্রাক চালিয়ে মাসে অন্তত দুবার পুরান ঢাকার বাবুবাজারে আসতে হয় মুরাদকে। সারা পথ যেমনতেমন, বাবুবাজারে ঢুকতেই ভয় ধরে তাঁর। কারণ, সড়কের বিশাল সব গর্ত পার হওয়ার সময় পণ্যবাহী ট্রাক দুলতে থাকে। তাঁর মনে হয়, ‘এই বুঝি...।’

বাবুবাজার সেতুর নিচের সড়কটি ৬৫০ মিটার দীর্ঘ। এই সড়কের এক পাশের ৮০ ভাগ ঢালাই উঠে গেছে। কিছু দূর পরপরই বিশাল গর্ত। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কাদা জমেছে। কোথাও কোথাও কাদার উচ্চতা ১ ফুটের মতো। এবড়োখেবড়ো এই সড়কে ঝুঁকি নিয়েই চলছে গাড়ি।

পণ্যবাহী শত শত ট্রাক প্রতিদিন এই সড়ক ব্যবহার করে চকবাজার ও বাদামতলীর পাইকারি বাজারে যায়। চকবাজারের পাশের ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীরাও তাঁদের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য এই সড়কের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এ ছাড়া পুরান ঢাকার একটি অংশের বাসিন্দারা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) যান এই সড়ক হয়ে।

গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে বাবুবাজার সেতুর নিচের এই সড়কে রিকশা-মোটরসাইকেল চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জাহাঙ্গীর শিকদারের সঙ্গে কথা হয় গত বুধবার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন এই সড়ক দিয়ে হাঁটলে কাদা লেগে কাপড় নষ্ট হয়ে যায়।

বাবুবাজার সেতু থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে গেন্ডারিয়া নতুন সড়ক। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কও খানাখন্দে ভরা। সড়কের কিছু কিছু জায়গায় গর্তের আকার এত বড় যে বৃষ্টি হলে তা পুকুরের মতো দেখায়। যাত্রী ও চালকদের ঝুঁকি নিয়ে এই পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

গেন্ডারিয়ার ব্যবসায়ী ইবরাহিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তার অবস্থা যা-তা। গর্তে পড়ে প্রায়ই রিকশা উল্টে যাচ্ছে।

শুধু এই দুটি সড়কই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ সড়ক বেহাল। সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত তিন বছরে সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে খরচ হয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ২৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১১১ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সড়ক সংস্কারে ব্যয় হয় ১০৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরে সড়কের উন্নয়নে ২৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত সোমবার থেকে বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ২০টি এলাকার প্রায় ৪৮ কিলোমিটার সড়ক মোটরসাইকেলে করে ঘুরে দেখেন। এর মধ্যে অন্তত ৩৫ কিলোমিটার সড়কের কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও বড় গর্ত দেখা গেছে। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে এসব সড়কে চলাচল করা মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরাই বলছেন, কাকরাইল জামে মসজিদের সামনে থেকে শাহবাগের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল পর্যন্ত সড়কটি (হেয়ার রোড) যে রকম মসৃণ, সেই মানদণ্ডে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ৫০ ভাগের বেশি সড়কের সংস্কার দরকার। দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার।

ভাঙাচোরা সড়কে চলা দায়

রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড় থোকে জুরাইন রেলগেট পর্যন্ত গেন্ডারিয়া নতুন সড়কে সর্বশেষ সংস্কারকাজ করা হয়েছিল ২০২০ সালে। কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই সড়কের এক পাশ পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পের অধীনে চলে যায়। বর্তমান সড়কের এক পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল করে। এই অংশের প্রায় পুরোটাই ব্যবহারের অযোগ্য বলে বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা বলছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সড়কের সংস্কারকাজ শুরু করার কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই।

গেন্ডারিয়া নতুন সড়কের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। মীর হাজীরবাগ, পার গেন্ডারিয়া, দোলাইরপাড় (পূর্ব ও পশ্চিম), শাহজালাল লেন ও নুরানীনগর নিয়ে গঠিত এই ওয়ার্ড। এখানকার সড়কের কী অবস্থা, তা স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানের বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরো ওয়ার্ডের মাত্র ২০ শতাংশ রাস্তা চলাচলের উপযোগী। এলাকার সড়কগুলোর সংস্কারকাজ শেষ হয়েছিল আড়াই বছর আগে। কিন্তু পাইপ বসানোর জন্য ওয়াসা সড়ক কেটেছে। এরপর আর সড়কের সংস্কার করেনি। তাঁর ওয়ার্ডের প্রায় দুই লাখ মানুষ দুরবস্থার মধ্যে আছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন বাবুবাজার সেতুর নিচের সড়ক এটি। পিচঢালাই উঠে সৃষ্টি হয়েছে বড় আকৃতির গর্তের। সেখানে জমেছে কাদাপানি। সড়কের কিনার ঘেঁষে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। গতকাল দুপুরে

গেন্ডারিয়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে টিকাটুলী এলাকার কে এম দাস লেন এলাকার মূল সড়কের প্রায় পুরোটা খানাখন্দে ভরা। পাশের গোপীবাগ এলাকার বিভিন্ন সড়কের একই অবস্থা। খানাখন্দে ভরা সড়কটি দিয়ে চলাচল করতে মানুষকে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

কে এম দাস লেন ও আর কে মিশন রোড ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। সড়কের দুরবস্থা নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর রোকন উদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে এলাকার বেশির ভাগ সড়কের সংস্কার হয়নি।

দক্ষিণ সিটির কামরাঙ্গীরচরের দক্ষিণ রসুলপুরের কাজীবাড়ি রোড, ব্যাটারিঘাট মেইন রোড, বড় গ্রাম মেইন রোড, মমিনবাগের মজিবর ঘাট, মধ্য মমিনবাগের আচারওয়ালা ঘাট রোড, আশ্রাফাবাদের কয়লাঘাট, লালবাগের মাক্কি মসজিদ-সংলগ্ন আর এন ডি রোড, রাজনারায়ণ ধর রোড, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোড, চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, নাজিমুদ্দিন রোড ও বংশালের বেগমবাজার এলাকার সড়কের অবস্থা বেশি খারাপ। এসব সড়কে পিচঢালাই উঠে গেছে।

৭ বছরে ব্যয় ৩ হাজার কোটি

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, গত সাত বছরে সড়কের উন্নয়নে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময় সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আর বর্তমান মেয়রের মেয়াদে গত তিন বছরে কেবল সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নে ২৪৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির সূত্র বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৫৩২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ৭৫২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে ৮৪৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়।

কেন সড়ক টিকছে না

দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, সঠিকভাবে একটি সড়কের উন্নয়ন করা হলে অন্তত ১০ বছর ভালো থাকার কথা। কিন্তু এখন দেড় থেকে দুই বছর না যেতেই ভালো সড়কের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারজন প্রকৌশলী বলেন, সড়ক সংস্কারের গুণগত মান ঠিক রাখার ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি-অনিয়ম। আবার যখন-তখন বিভিন্ন সংস্থা অপরিকল্পিতভাবে সড়ক কাটছে। যেমন বৈদ্যুতিক তার প্রতিস্থাপন, গ্যাস-সংযোগ ও খাওয়ার পানির সংযোগের জন্য সড়ক খোঁড়া হচ্ছে। সড়ক উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজে ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম ও যোগ্যতার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে মানা হয় না। ঠিকাদার কাজটি ঠিকমতো করার সক্ষমতা রাখেন কি না, সেটি দেখা হয় না। এ ক্ষেত্রে ‘পছন্দ-অপছন্দ’ কাজ করে। আবার ঠিকাদার কাজ ঠিকমতো করছেন কি না, সেই তদারকিতেও ঘাটতি থাকে।

একটি উদাহরণ দিয়ে ওই প্রকৌশলীরা বলেন, পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের সড়ক ও নালার সংস্কারকাজ ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ওই কাজ ঠিকাদার শেষ করেননি। ওই ঠিকাদার মেয়রের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তাঁকে চাপ দিয়েও কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। প্রায় সাত কোটি টাকার এই কাজ শেষ হলে এলাকার জলাবদ্ধ পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হতো। পাশাপাশি ভাঙাচোরা সড়কও ঠিক হতো।

কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৯ মাস পরও কাজী আলাউদ্দিন সড়ক ও নালার সংস্কারকাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ।

প্রথম আলো জানতে পেরেছে, সড়ক ও নালা সংস্কারের ওই কাজ করছেন ঠিকাদার কাজী মোর্শেদ হোসেন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

কবে কাজ শেষ হবে, তা জানতে চাইলে ঠিকাদার কাজী মোর্শেদ গতকাল শুক্রবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টির কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। রাস্তায় পানি জমে আছে। এ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। তবে ছয় মাসের কাজ শেষ হতে ২৬ মাসে কেন লাগছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।

সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারে বছর বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করা হলেও বেশির ভাগ এলাকার বেহাল সড়কের বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। তিনি মনোযোগ দিয়ে পুরো বিষয়টি শোনেন। এরপর এই প্রতিবেদককে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে আশিকুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।

কোন বছরে কোন এলাকার সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজ হবে, সেই পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের না থাকায় সমস্যা প্রকট হচ্ছে বলে মনে করেন নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পনা থাকলে কোন সড়কের কখন সংস্কার দরকার, সেটি জানা থাকত সিটি করপোরেশনের। কিন্তু তারা এখন অনেকটা চোখের দেখায় এবং অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজ করে।

সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারা সিটি করপোরেশনের বড় দুর্বলতা বলেও উল্লেখ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রেও বৈষম্য করছে সিটি করপোরেশন। দেখা যাচ্ছে, উন্নত এলাকায় মনোযোগ যতটা বেশি থাকে, তার তুলনায় অনেক কম মনোযোগ থাকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকায়। অথচ সব এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে সিটি করপোরেশন কর আদায় করছে।