জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর ভুল বুঝতে পেরে পরিবারের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন তাঁরা চারজন। কেউ কেউ দুই দফা পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের নির্দেশে ওই চারজনকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। গত বছরে পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে সুযোগ বুঝে তাঁরা অন্য জঙ্গিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে আসেন। গতকাল মঙ্গলবার আত্মসমর্পণ করেন র্যাবের নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নে।
জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার এই চার সদস্যের একজনের বয়স ১৬ বছর। অন্য তিনজন হলো হাসান সাইদ (২৬), শেখ আহমেদ মামুন (২৩) ও মো. ইয়াছিন (২১)।
আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানান।
ওই চারজনের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ওই চারজন বিভিন্ন সময়ে পরিচিতজনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াতে যোগ দেন। পরে জঙ্গি সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা তাঁদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কথিত হিজরতের কথা বলে পাহাড়ে যেতে আগ্রহী করে। পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সহযোগিতায় সংগঠনটির সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দেখে তাঁদের ভুল ভাঙে। পরে ওই চারজনসহ বেশ কিছু সদস্য সমতলে ফিরতে চাইলেও তাঁদের বন্দী রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে তাঁদের জোর করে রসদ পরিবহন, রান্নাবান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত করা, ঘর বানানোসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করানো হতো।
র্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, ২০২২ সালের জুন মাসে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে রনি পাড়া এসে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা খোঁজার সময় তাঁরা কেএনএফ সদস্যদের হাতে ধরা পরেন। এ সময় তাঁদের বন্দী রেখে আবারও নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। এরপর কখনো পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। পরে পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তাঁরা পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে পালিয়ে গত মার্চে সমতলে চলে আসেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন থাকা শুরু করেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে র্যাবের কাছে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ ও ভুল বুঝতে পারা জঙ্গিদের আইনগত সহযোগিতার বিষয়টি তাঁরা জানতে পারেন। তাই গতকাল র্যাবের নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নে হাজির হন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে হাসান সাঈদ র্যাবকে জানান, তিনি স্থানীয় মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ২০২১ সালে সুরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেন। তিনি ২০২১ সালের নভেম্বরে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে সুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পাহাড়ে যান। ভুল বুঝতে পেরে তাঁরা চার–পাঁচজন পালাতে চাইলে একবার তাঁরা ধরা পড়ে যান।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শেখ আহমেদ মামুন বলেন, তিনি সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে পড়তেন। ২০২১ সালে সে সাঈদের মাধ্যমে হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেন। সাঈদের সঙ্গে তিনি দুবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন।
ইয়াছিনকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানায়, তিনি এলাকায় ঘড়ি মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। ২০২১ সালে তিনি সিরাজের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনটিতে যোগ দেন এবং ২০২১ এর নভেম্বরে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে গমন করেন। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে তিনি ভুল বুঝতে পারেন এবং সমতলে ফিরে আসেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ইতিমধ্যে এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া কেএনএফের ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব অভিযানে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও উগ্রবাদী বই উদ্ধার করা হয়। র্যাব হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপপ্রধান মানিক, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কেএনএফের প্রধান নাথান বমের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের সুবাদে অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গিদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিত।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এক মা এবং তিনি নিজেই তাঁর একমাত্র ছেলেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন। তিনি র্যাবের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে অনুতপ্ত হয়ে ছেলেকে ফিরে পেতে গত ৯ নভেম্বর গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে তাঁর সন্তানসহ অন্য তরুণদের ফিরে আসার আকুতি জানান।