জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সিস্টেমে ধীরগতির কারণে গত বছর ভোগান্তি যখন চরমে, তখন নিজস্ব সার্ভার তৈরি করে কাজ শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে ডিএসসিসি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে স্বস্তি আসে। কারণ, তাঁরা খুব সহজে জন্মনিবন্ধন করতে পারছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, ১৮ বছরের কম বয়সী যাদের পাসপোর্ট করতে জন্মনিবন্ধন সনদ লাগে বা যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাদের ডিএসসিসির জন্মসনদ দিয়ে পাসপোর্ট করা যাচ্ছে না।
১০ মাসের বেশি সময় ধরে ডিএসসিসির জন্মসনদ নিয়ে এ সমস্যা চলছে। ঠিক কবে সমস্যার সমাধান হবে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পাসপোর্টের প্রয়োজনে ডিএসসিসি এলাকার বাইরে গিয়ে ঠিকানা পাল্টে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করছেন অনেকে।
সম্প্রতি ডিএসসিসি এলাকার এক বাসিন্দা তাঁর ছোট ছেলের পাসপোর্ট করার জন্য গিয়ে ফেরত আসেন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে তাঁকে বলা হয়, তাঁর ছেলের জন্মসনদের নম্বর সিস্টেমে (সার্ভার) নেই। পরে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় অবস্থিত তাঁর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় ছেলের জন্মনিবন্ধন করেন।
কেন ডিএসসিসি এলাকায় করা জন্মসনদ পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সিস্টেমে দেখা যায় না, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য জমা হয় ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে। নিবন্ধন নম্বরের মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ে এ কার্যালয়ের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তযোগাযোগের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) আছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা সার্ভারের সঙ্গে ডিএসএসসির নিজস্ব সার্ভারের আন্তসংযোগ নেই। ফলে ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে জমা হচ্ছে না। এ কারণে পাসপোর্ট করতে গেলে পাসপোর্ট অধিদপ্তর রেজিস্ট্রার জেনারেলের সিস্টেমে প্রবেশ করলে ডিএসসিসি থেকে দেওয়া সনদের তথ্য খুঁজে পায় না।
কেরানীগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অধিক্ষেত্রে ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকা অন্তর্ভুক্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে জন্মসনদের নম্বর খুঁজে না পাওয়ার কারণে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতজনের পাসপোর্টের আবেদন ফরম ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ডিএসসিসি এলাকার বাসিন্দারা পাসপোর্ট করতে এসে বুঝতে পারছেন, ওই জন্মসনদ সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ডিএসসিসির বাইরের যেকোনো এলাকার ঠিকানায় জন্মনিবন্ধন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ঠিকানা বদলে জন্মনিবন্ধন করে আসা ব্যক্তিদের তথ্য ঠিক থাকলে পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়।
কেরানীগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে ডিএসসিসির জন্মসনদ নিয়ে ফেরত আসা ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেখানকার উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সিস্টেমের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের ইন্টিগ্রেশন (একীভূত) আছে, ডিএসসিসির সঙ্গে নেই। ফলে ডিএসসিসির জন্মসনদ নিয়ে যাঁরা পাসপোর্ট করতে আসছেন, তাঁদের সনদ নম্বর সিস্টেমে আসে না। এ কারণে তাঁদের আবেদন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ডিএসসিসি ছাড়া সারা দেশের যেকোনো জায়গা থেকে করা জন্মনিবন্ধন নম্বর আমাদের সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে।’
শুধু পাসপোর্ট নয়, শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সেবা নিতে জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। এই সেবাগুলো নেওয়ার জন্য ডিএসসিসিকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে শুরু করে মোট ২২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ সই করতে হবে। এ ছাড়া জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের বিদ্যমান আইন-বিধিও সংশোধন করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন লাগবে।
রাজস্বের অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমার দাবিতে গত বছর প্রায় তিন মাস জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ রেখেছিল ডিএসসিসি। পরে গত বছরের ৪ অক্টোবর নিজস্ব সিস্টেম দিয়ে তারা নিবন্ধনের কাজ শুরু করে।
ডিএসসিসির সিস্টেমে এখানকার বাসিন্দারা ক্লিক করে অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। অন্যদিকে সারা দেশে যে সিস্টেমে নিবন্ধন হয়, সেটির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয়ভাবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের হাতে।
ডিএসসিসির নিজস্ব সিস্টেমে নিবন্ধনের বিষয়টিকে আইন-বিধির লঙ্ঘন উল্লেখ করে গত বছরের ১৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠান তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল।
চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ৭ (ক) (২) এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারা তুলে ধরা হয়।
আইনের ৭ (ক) (২) ধারা অনুসারে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। আর বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারায় উল্লেখ আছে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের।
পাসপোর্ট করতে সমস্যা দেখা দিলে গত বছরের ১৮ অক্টোবর ২২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে একটি চিঠি ইস্যু করে ডিএসসিসি। চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ যাচাইয়ে ডিএসসিসির সিস্টেমে ক্লিক করে কিউআর কোড ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
তবে পাসপোর্ট আবেদনপ্রক্রিয়ার সফটওয়্যারে কিউআর কোড স্ক্যান করার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কেন্দ্রীয় সিস্টেমে জন্মনিবন্ধন নম্বর না থাকলে পাসপোর্ট কার্যালয়ের সফটওয়্যারে তা আসবে না।
এখন পাসপোর্টবিষয়ক সমস্যার সমাধানে কাজ চলছে বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানান ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের। তবে তিনি এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ডিএসসিসি এলাকার অনেক বাসিন্দা পাসপোর্ট করার জন্য ঠিকানা বদলে জন্মনিবন্ধন করছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু নাছের বলেন, ‘সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়। এটা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়।’
এদিকে নিজস্ব সিস্টেমে নতুন সনদ দিতে পারলেও পুরোনো সনদ সংশোধন করতে পারে না ডিএসসিসি। এ অবস্থায় পুরোনো সনদ সংশোধনে দক্ষিণ সিটির বাসিন্দাদের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্যভান্ডারের (ডেটাবেস) হস্তান্তর চেয়ে গত বছরের ১৮ অক্টোবর রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়কে আলাদা চিঠি দেয় ডিএসসিসি।
ডিএসসির নিজস্ব সার্ভার আইনসম্মত নয় উল্লেখ করে তথ্যভান্ডার হস্তান্তরে সম্মত হয়নি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়।
চলমান সমস্যার সমাধান কবে হবে, জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন ৭ মে তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের। দেশের সব সিটি করপোরেশন এই সিস্টেমে কাজ করছে। শুধু ডিএসসিসির কেন এত সমস্যা? ডিএসসিসির নিজস্ব সিস্টেমে নিবন্ধনের কাজ করা আইন ও বিধির ব্যত্যয়। এভাবে আলাদাভাবে নিবন্ধনের কাজ করতে হলে আগে আইন ও বিধির সংশোধন করতে হবে। সমস্যার কবে সমাধান হবে, জানা নেই।’