নগরবাসীর সেবায় চালু করা অ্যাপে অভিযোগ ও সমাধানের সংখ্যা বাড়াতেই এমন কৌশল।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছিল মাত্র ১২ হাজার ২০১টি। কিন্তু পরের ৯ মাসেই সেই অভিযোগ বেড়ে যায় প্রায় ১২ গুণ, যা সংখ্যার হিসাবে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ২১৮টি। এর কারণ, নগরবাসীর পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কর্মীদেরও ওই অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ করতে হচ্ছে।
নিজেদের করা অভিযোগের সমাধান আবার তাঁরাই দিচ্ছেন। অভিযোগ ও সমাধানের সংখ্যা বাড়াতেই এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিভিন্ন বিভাগ থেকেও অ্যাপে অভিযোগ দেওয়ার জন্য কর্মীদের লিখিত ও মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন মশক সুপারভাইজার ও পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মীদের দিনে কমপক্ষে পাঁচটি অভিযোগ করতে হচ্ছে। নির্দেশনা পেয়ে কোনো কোনো কর্মী ১ হাজার ৪০০ পর্যন্ত অভিযোগ দিয়েছেন। এ কারণেই বেড়েছে অভিযোগের সংখ্যা।
কর্মীদের এভাবে কাজ করানোর কারণে শহরের অনেক সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান হচ্ছে। তাই এ নিয়ে কে কী বলছেন, সেসব নিয়ে ভাবছি না।আতিকুল ইসলাম, মেয়র, ডিএনসিসি
কর্মীদের দিয়ে এভাবে অভিযোগ করানোর বিষয়ে সিটি করপোরেশন বলছে, কর্মীরা যাতে কাজে ফাঁকি না দিয়ে নিজেরা সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নেন, সে জন্যই তাঁদের দিয়ে অভিযোগ করানো হচ্ছে।
নগরবাসীর সেবায় তৈরি করা ওই অ্যাপের নাম ‘সবার ঢাকা’। গত বছরের ১০ জানুয়ারি ডিএনসিসি এই অ্যাপ উদ্বোধন করে। দুই বছরের রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তিতে সবার ঢাকা অ্যাপ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে সিটি করপোরেশনের ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। অ্যাপটি চালুর উদ্দেশ্য ছিল, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নগরবাসী অভিযোগ দেবেন। আর সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা সেসব দ্রুত সমাধান করবেন। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৬ হাজার ৫৪৫।
ডিএনসিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারী পর্যায়ের অন্তত ১৭ জনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা বলছেন, অ্যাপে নগরবাসীর সাড়া না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট ছিল না। অ্যাপটিতে অভিযোগ ও সমাধানের সংখ্যা বাড়াতে কর্মীদের দিয়ে অভিযোগ করানো শুরু হয়। এমনকি প্রতিদিন সর্বনিম্ন কতটি অভিযোগ করতে হবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
অ্যাপে মশার প্রজননস্থলের তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর একটি লিখিত চিঠি দিয়েছে ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ। এতে বলা হয়, মশার প্রজননস্থল ও মশা নিধনের তথ্য অ্যাপে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এসব তথ্য দিচ্ছেন না। এ নিয়ে মেয়র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাই এ-সংক্রান্ত সার্বিক তথ্য নিয়মিত অ্যাপে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডিএনসিসির উচিত ছিল, কেন নগরবাসীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে অনুসন্ধান করা, প্রয়োজনে গবেষণা কিংবা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া।ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
তবে বিশেষ ওই আদেশ নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। যদিও চিঠিটি ওয়েবসাইটে প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে অনুলিপিতে সিস্টেম অ্যানালিস্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
লিখিত নির্দেশনার বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাঠে কর্মীরা কাজ করছেন কি না, সেটা যাচাইয়ের জন্য এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—কর্মীকে নির্দিষ্ট ওই অভিযোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এর মধ্যে নগরবাসীর সমস্যাগুলোও উঠে আসছে।
নির্দেশনা পেয়ে নড়েচড়ে বসেন মশকনিধন কাজে যুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। যে কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে মশার সমস্যা নিয়ে অ্যাপে ৮৭ হাজার ৬০৯টি অভিযোগ এসেছে। কর্মীদের দেওয়া অভিযোগের সমাধান দেখানো হয়েছে ৯৬ থেকে ১০০ শতাংশ। এর মধ্যে ছয় মাসের অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে ৯৯ শতাংশ। বাকি তিনটি মাসের অভিযোগ ৯৬, ৯৮ এবং ১০০ শতাংশ সমাধান দেখানো হয়েছে।
২০২১ সালে মশার অভিযোগ ছিল ৩ হাজার ৩০৪টি। ওই সময় প্রতি মাসের অভিযোগ শতভাগ সমাধান হয়েছে বলে দেখানো হয়।
একাধিক মশককর্মী ও সুপারভাইজার প্রথম আলোকে জানান, ওই নির্দেশের পর এমন ঘটনাও ঘটেছে যে তালিকা অনুযায়ী যেখানে পরের দিন মশার ওষুধ ছিটানোর কথা, সেখানে আগের দিন গিয়ে কিছু জায়গার ছবি তুলে প্রথমে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। পরের দিন ওষুধ ছিটানোর রুটিন কাজ করে তা সমাধান দেখানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা বলছেন, তাঁদের প্রত্যেক কর্মীকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি অভিযোগ দিতে হয়। তাঁরা মূলত মশার প্রজননস্থল, পানি জমে থাকা, নালা, রাস্তা ও খালের ময়লা আবর্জনা এবং নালা আটকে যাওয়া নিয়ে অভিযোগ দেন।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার এক পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক (সিআই) প্রথম আলোকে জানান, তাঁকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি করে অভিযোগ দিতে হয়েছে। অভিযোগগুলো এক-দুই দিন পরে তিনি সমাধান করে এসেছেন।
ওই পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্বে। এর একটিতে এক হাজারের বেশি, অন্যটিতে পাঁচ শর বেশি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের অভিযোগ ১০-১৫ শতাংশ। বাকি সব তাঁর নিজের।
নিজেদের অভিযোগ নিজেরাই সমাধান করেন—এ নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে একজন মশক সুপারভাইজার প্রথম আলোকে বলেন, এই সিদ্ধান্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। তাই কোনো মন্তব্য করতে চাইছি না।
কর্মীদের দিয়ে অভিযোগ করানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কর্মীরা সমস্যা দেখল না, সমাধানও করল না, তখন সমস্যা আরও বাড়বে। তাই কর্মীরা যাতে কাজে ফাঁকি দিতে না পারেন, সে জন্যই তাঁদের সমস্যা খুঁজে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। সেগুলোর সমাধানও তাঁদেরই করতে হচ্ছে। এর ফলে ময়লা শনাক্ত ও পরিষ্কার—এই দুটি কাজ নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা থেকেই কর্মীদের এ কাজ করানো হচ্ছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘কর্মীদের এভাবে কাজ করানোর কারণে শহরের অনেক সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান হচ্ছে। তাই এ নিয়ে কে কী বলছেন, সেসব নিয়ে ভাবছি না। আমি দেখছি সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে, সমস্যার সমাধান হচ্ছে।’
বিষয়টিকে ‘প্রতারণামূলক কার্যক্রম’ বলে উল্লেখ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের এমন প্রতারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। ডিএনসিসি অত্যন্ত নেতিবাচক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। দায়ীদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডিএনসিসির উচিত ছিল, কেন নগরবাসীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে অনুসন্ধান করা, প্রয়োজনে গবেষণা কিংবা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া। কিন্তু তা না করে যা করেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।