ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে ফাঁকা পড়ে থাকা শয্যা। সম্প্রতি তোলা।
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে ফাঁকা পড়ে থাকা শয্যা। সম্প্রতি তোলা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির তিন হাসপাতালে জনবল সংকট, সেবায় ঘাটতি

সিটি করপোরেশনের অধীন ২৮টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৫টি নগর মাতৃসদনও রয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষই এসব হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন বেশি।

ওয়ার্ডগুলোর শয্যা অপরিচ্ছন্ন। ঢোকার অবস্থা নেই বেশির ভাগ কক্ষে। একটি ওয়ার্ডে কয়েকজন রোগী ভর্তি আছেন। জানালেন, রাতেই বাড়ি ফিরবেন। কারণ, সেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত নার্স নেই। এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালিত ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতালের চিত্র।

এ ছাড়া আরও দুটি হাসপাতাল পরিচালনা করে ডিএসসিসি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে করোনাকালে স্থাপিত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও হাইফ্লো অক্সিজেন সরঞ্জাম ও জনবলের সংকটের কারণে এক দিনের জন্যও ব্যবহার করা যায়নি। আর নাজিরাবাজার মাতৃসদনে আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র চালানোর জনবল নেই।

এ তিন বড় হাসপাতালের পাশাপাশি দক্ষিণ ঢাকায় ডিএসসিসির অধীন ২৮টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৫টি নগর মাতৃসদন রয়েছে। স্থানীয় সরকারের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয়। আর বড় তিন হাসপাতাল সিটি করপোরেশন নিজেই পরিচালনা করে।

রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষজনই এসব হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বেশি নেন। হাসপাতালগুলোতে খরচ সামান্য ও বেশ কিছু সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। কিন্তু অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবলের সংকটে ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না মানুষ।

সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে এই তিন হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বাদে খরচ হয়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর ওষুধ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা এবং রোগীর খাবারসহ বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

শয্যা ১০০, তবু রোগীদের ভর্তি রাখা যায় না

পুরান ঢাকার চকবাজারে ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতালে বহির্বিভাগে রোগী দেখাতে বা হাসপাতালে ভর্তিতে দিতে হয় মাত্র ১০ টাকা। ভর্তির পর বিনা মূল্যে খাবার পান রোগীরা। থাকতেও কোনো টাকা লাগে না। বিনা মূল্যে দেওয়া হয় বেশ কিছু ওষুধ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও বেশি নয়।

এরপরও এই হাসপাতাল থেকে মিলছে না পরিপূর্ণ সেবা। কারণ, চিকিৎসক ও নার্সের সংকট চলছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। সংকট আছে অন্যান্য পদে থাকা কর্মীরও। এতে কাজে লাগানো যাচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি। এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা বলেন, এখানকার তিন ভাগের দুই ভাগ রোগী রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জ থেকে আসা। অন্যরা পুরান ঢাকার।

সম্প্রতি হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, কম বয়সী শিশু নিয়ে অপেক্ষা করছেন আট নারী। জ্বর, জন্ডিস, সর্দি—এসব রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি। হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বেশির ভাগই ফিরে যাচ্ছেন। ভর্তি করাতে চাইলেও করানো যাচ্ছে না। কারণ, দেখভালের জন্য পর্যাপ্ত নার্স নেই।

অন্তত তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে ১০০ শিশু ভর্তি করানোর মতো ব্যবস্থা আছে। জনবলের ঘাটতির কারণে তাঁরা রোগী ভর্তি নিচ্ছেন না। সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত জনবলকাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসক থাকার কথা ২১ জন। আছেন ৮ জন। নার্সসহ এই হাসপাতালে মোট ১৩০ জন জনবলের প্রয়োজন থাকলেও আছেন ৭১ জন। নার্স ৩০ জনের জায়গায় আছেন মাত্র ৬ জন।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, জনবলের সংকটে বিভিন্ন ওয়ার্ডের শয্যা অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে। নোংরা পরিবেশের কারণে বেশির ভাগ কক্ষে প্রবেশ করার মতো অবস্থা নেই। চারতলা ভবনের বড় অবকাঠামো থাকলেও বেশির ভাগ কক্ষ ব্যবহৃত হচ্ছে না।

একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দিনে গড়ে ২৫০ রোগী এ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভর্তি হন তিন-চারজন। হাসপাতাল হতে হয় নিজের ঘরের চেয়েও সুন্দর। কিন্তু জনবলের সংকটে তাঁরা পরিবেশ ঠিক রাখতে পারছেন না।

আইসিইউ ব্যবহৃত হয়নি এক দিনও

ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ১৫০টি। এখানে ৩১ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। করোনা মহামারির সময় এ হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছিল। হাইফ্লো অক্সিজেন সরঞ্জামও বসানো হয়েছিল। কিন্তু জনবলের সংকটে কোনো কিছুই ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না।

হাসপাতালে যন্ত্রপাতি দিয়ে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করাতে সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা খরচ হয়। এ হাসপাতালে ১০টি কেবিন আছে। কর্তৃপক্ষ ভর্তি রোগীদের অন্তত ৪৫ ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে দিয়ে থাকে। গড়ে ৪০০ রোগী বর্তমানে বহির্বিভাগ থেকে দিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভর্তি হন পাঁচ-ছয়জন। হাসপাতালের পরিচালক আম্মাতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা বলেন, অবকাঠামো থাকার পরও চিকিৎসক সংকটে পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছেন না তাঁরা।

করোনাকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ শয্যা ও ১২টি হাইফ্লো অক্সিজেন সরঞ্জাম স্থাপন করলেও এসব যন্ত্রপাতি এক দিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এসব যন্ত্র এখন ঠিক আছে কি না, তা-ও তাঁরা বলতে পারছেন না।

গত ৭ নভেম্বর আম্মাতা নূর ওয়াহিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে এখন পর্যন্ত তাঁরা তিনবার চিঠি দিয়েছেন। পরে তাঁকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, যন্ত্রপাতিগুলো সরকারি যে হাসপাতালে দরকার, সে হাসপাতালে যেন পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেগুলো পাঠানো যায়নি।

হাসপাতাল সূত্র আরও বলছে, জনবলকাঠামো অনুযায়ী এ হাসপাতালে ৩২ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু আছেন ১৭ জন। হাসপাতালটিতে মোট ১৩৬ জন কর্মী থাকার কথা থাকলেও আছেন ৭০ জন।

মাতৃসদনে মিলছে না আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবা

একই রকম অবস্থা নাজিরাবাজার মাতৃসদনের। ৩১ শয্যার এ হাসপাতালে নারী ও শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। অন্য দুটি হাসপাতালের মতো বেশিসংখ্যক পরীক্ষার ব্যবস্থা এই হাসপাতালে নেই জানিয়ে পরিচালক সাথী খানম বলেন, রক্তের কয়েকটি ধরন পরীক্ষা করার ব্যবস্থা তাঁদের আছে। এ হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনবল না থাকায় চালু করা যায়নি।

দক্ষিণ ঢাকার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রেষণের পরিবর্তে নিজস্ব পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগ করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে নথি পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগির এটি অনুমোদন হবে বলে আশা করছি।’ পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করে পুরোপুরি সেবা প্রদানের বিষয়েও তিনি আশাবাদী।