রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় এক বৈমানিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। আজ সোমবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেন তাঁর বোন তালা এলহেনডি।
ওই বৈমানিকের নাম ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসুফ আল হিন্দি। তিনি বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা গালফ এয়ারে কর্মরত ছিলেন। মোহান্নাদ ইউসুফ যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের দ্বৈত নাগরিক ছিলেন। গত ২২ ডিসেম্বর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তির পর মৃত্যু হয় তাঁর।
তালা এলহেনডি বলেন, গত ২২ ডিসেম্বর সকালে গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করার কথা ছিল ইউসুফের। আগের দিন দিবাগত রাত পৌনে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত হন তিনি। এরপর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখন তিনি নিচে পড়ে নিথর হয়ে যান।
বিমানবন্দরে মোহান্নাদ ইউসুফের প্রথম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় উল্লেখ করে তালা এলহেনডি বলেন, এরপর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে তিনি মারা যান।
তালা এলহেনডির অভিযোগ, তাঁর ভাইকে হাসপাতালে ভর্তির পর সকাল নয়টার আগপর্যন্ত সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট সশরীর উপস্থিত ছিলেন না।
কার্ডিওলজিস্টের উপস্থিতি ছাড়াই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। সকাল নয়টার পরও কোনো কার্ডিওলজিস্ট এসে চিকিৎসা দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
চিকিৎসায় বিলম্বের অভিযোগ তুলে তালা এলহেনডি বলেন, ওই দিন সকাল পৌনে সাতটায় তাঁর ভাইয়ের দ্বিতীয় এবং এর ২০ মিনিট পর তৃতীয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তিনি বলেন, ‘দুই ঘণ্টার ব্যবধানে আমার ভাইয়ের তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। সোয়া দুই ঘণ্টা পর্যন্ত তাঁকে কোনো চিকিৎসাসেবা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়েছিল।’
মোহান্নাদ ইউসুফকে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছিল উল্লেখ করে তাঁর বোন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে সেখানে অন্তত একজন কার্ডিওলজিস্ট থাকা ও তাৎক্ষণিক বিশেষ সেবা দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু অদক্ষ চিকিৎসকেরা অবহেলা করেছেন। কার্ডিওলজির জন্য একটি ইউনিট করা হলেও সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। পরে বেলা সোয়া ১১টায় চিকিৎসা চলার মধ্যেই আমার ভাইয়ের চতুর্থ ও শেষবারের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। পেসমেকার বসানোর পরই তিনি মারা যান।’
ঢাকায় এসে নিজস্ব অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে তালা এলহেনডি বলেন, ‘আমি পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পেয়েছি যে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও হাসপাতালের কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে। এ ছাড়া আমি যখন অনুসন্ধান করছিলাম, তখন হাসপাতালের কর্মীরাও আমাকে ভয় দেখিয়েছেন। ২৬ জানুয়ারি হাসপাতালের কাছে আমি চিকিৎসার কাগজপত্র ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রমাণাদি কারসাজি করতে তাঁরা এসব দিতে তিন দিন সময় নিয়েছিলেন।’
গালফ এয়ারও তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসায় অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তালা এলহেনডি। তিনি বলেন, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর আমার ভাই অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সেই অবস্থাতেই ছিলেন। গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় এটা হয়েছে। তিনি এই ফ্লাইটের একজন পাইলট ছিলেন। নিজের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কাজেই গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল, তিনি যাতে সঠিক চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করা।’
গালফ এয়ার কোনো কর্মকর্তাকে হাসপাতালে পাঠায়নি অভিযোগ করে তালা এলহেনডি বলেন, ‘গালফ এয়ারের কাছে থাকা আমার ভাইয়ের অতীতের চিকিৎসার ইতিহাস ওই হাসপাতালে জমা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। এমনকি পরিবারের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে কোনো কর্মকর্তাকে হাসপাতালে পাঠায়নি। আমার ভাইয়ের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি গালফ এয়ারকে।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে তালা এলহেনডি তাঁর দাবি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ নির্ভেজাল রিপোর্ট ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ চাই। ভুক্তভোগীর বোন হিসেবে আমার ভাইয়ের চিকিৎসার আদ্যোপান্ত জানতে চাই। কার মাধ্যমে এসব হয়েছে, তা-ও জানার অধিকার আমার আছে। হাসপাতাল বলছে, আমার ভাইয়ের চিকিৎসার কাগজপত্র গোপনীয় নথি। তারা চিকিৎসার কাগজপত্রে কারসাজি করেছে। আমার ভাইয়ের নির্ভেজাল কাগজপত্র হাতে পাওয়া অবৈধ কিংবা অনৈতিক কিছু নয়।’
এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টান্তমূলক জরিমানার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তারা মূলত আমার ভাইকে হত্যা করেছে।’ একই সঙ্গে তিনি ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও লাইসেন্স বাতিলের দাবি করেছেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক আরিফুল হকের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘটনার দিন ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে মুমূর্ষু অবস্থায় ইউসুফ আল হিন্দিকে (৬৩) নিয়ে আসা হয়। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়ার পরও তাঁর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে তিনি মারা যান।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, একজন ভদ্রমহিলা ইউসুফ আল হিন্দির বোন পরিচয় দিয়ে ভিডিও ফুটেজ ও মেডিকেল রেকর্ড দেখতে চান। তাঁকে সম্পর্কের প্রমাণসহ আবেদন করতে বলা হয়। পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।