ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি প্রতিষ্ঠানটির বিতর্কিত সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের সময় অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকসিমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়।
এদিকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নতুন এমডি হিসেবে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ কে এম সহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দেওয়ায় কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তুোষ।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৫ আগস্ট ওয়াসার এমডি তাকসিম খানের নতুন চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল করে সরকার।
এ কে এম সহিদ উদ্দিন ২০১৬ সালে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাঁকে দুই বছরের চুক্তিতে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন এমডি তাকসিম এ খান। অথচ ঢাকা ওয়াসার জনবলকাঠামোয় এমন কোনো পদ নেই। তাকসিম খান নিজ ক্ষমতাবলে এ পদ সৃষ্টি করে সহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাকসিম খানের নিয়োগ বাতিলের প্রজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠতম ডিএমডিকে এমডির দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু জ্যেষ্ঠতার তালিকা তৈরি করতে গিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এ কে এম সহিদ উদ্দিন নিজেই পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, এ কে এম সহিদ উদ্দিন ২০১৬ সালে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাঁকে দুই বছরের চুক্তিতে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন এমডি তাকসিম এ খান। অথচ ঢাকা ওয়াসার জনবলকাঠামোয় এমন কোনো পদ নেই। তাকসিম খান নিজ ক্ষমতাবলে এ পদ সৃষ্টি করে সহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দেন।
সহিদ উদ্দিনকে এভাবে পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাকসিম এ খানসহ ঢাকা ওয়াসার নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধ নিয়োগ দিয়ে তাঁরা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার তিন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের বোর্ড সভা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি বালা এমডি পদে সহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। বোর্ড সভা ছাড়া এভাবে নিয়োগ বৈধ নয়। আবার এ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য জ্যেষ্ঠতার যে তালিকা তৈরি করা হয়, সেটিও করেছেন সহিদ উদ্দিন নিজেই। সেখানে তিনি নিজের নাম এক নম্বরে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার নির্দেশনা মানা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিতে বয়স ও প্রকৌশলগত অভিজ্ঞতায় তিনি জ্যেষ্ঠ। তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
ঢাকা ওয়াসা সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানটিতে ডিএমডি পদে কর্মরত ছিলেন চারজন। সহিদ উদ্দিন ছাড়া অপর তিনজন হলেন সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ ইয়াজদানি, মো. আক্তারুজ্জামান ও মিজানুর রহমান। তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ডিএমডি মোহাম্মদ ইয়াজদানি। তাকসিম খানের রোষানলে পড়ে বরখাস্ত হলে উচ্চ আদালতে যান তিনি। ১০ জুন বরখাস্তের সিদ্ধান্ত অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর আদালতের রায় নিয়ে ঘুরলেও তিনি কাজে যোগদান করতে পারেননি। এদিকে আক্তারুজ্জামানকে ডিএমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২২ সালের ১০ মে। চার মাস পর একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান বাকি দুই ডিএমডি সহিদ উদ্দিন ও মিজানুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো বোর্ড না থাকায় মোহাম্মদ ইয়াজদানি কাজে যোগ দিতে পারছেন না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠ ডিএমডি হিসেবে এমডি পদে চলতি দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল মো. আক্তারুজ্জামানের।
তাকসিম এ খানের আগে সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব এ সংস্থার এমডি ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এভাবে এমডির দায়িত্ব দেওয়ার মূল লক্ষ্য হলো তাকসিম খান ও তাঁর ‘সিন্ডিকেটের দুর্নীতি’ আড়াল করা। তা করতে তাকসিমের অনুগত সাবেক চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি বালা এমডি পদে সহিদ উদ্দিনকে বসিয়েছেন।ঢাকা ওয়াসার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তা
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি বালা প্রথম আলোকে বলেন, চেয়ারম্যানের পদে তিনি চার বছর দায়িত্ব পালনকালে বুঝতে পেরেছেন, কাকে দিলে ঢাকা ওয়াসা ভালো চলবে। যাঁকে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি প্রকৌশলী। ওয়াসায় তাঁর কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সহিদ উদ্দিনের মতো ঢাকা ওয়াসায় এত জানাশোনা লোক নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যাঁকে জ্যেষ্ঠ বলা হচ্ছে, তিনি একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। প্রকৌশলগত বিষয় তিনি ভালো বুঝবেন না। প্রকৌশলী ছাড়া এ পদে কাউকে নিয়োগ দিলে হযবরল হবে। তিনি যা করেছেন, ভালোর জন্য করেছেন। এরপরও কেউ তাঁকে দোষারোপ করলে তা মাথা পেতে নেবেন।
তবে ঢাকা ওয়াসার দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাকসিম এ খানের আগে সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব এ সংস্থার এমডি ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এভাবে এমডির দায়িত্ব দেওয়ার মূল লক্ষ্য হলো তাকসিম খান ও তাঁর ‘সিন্ডিকেটের দুর্নীতি’ আড়াল করা। তা করতে তাকসিমের অনুগত সাবেক চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি বালা এমডি পদে সহিদ উদ্দিনকে বসিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এমডির পদে দায়িত্ব নিয়ে এখন সহিদ উদ্দিন সাবেক এমডি তাকসিমের সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের সুরক্ষা ও স্বপদে বহাল রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন। দ্রুত এমডির পদ থেকে তাঁকে সরানোর পাশাপাশি তাকসিমের সময়ে হওয়া দুর্নীতিতে জড়িত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।