ঢাকা ওয়াসা: ৪৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ

সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছে, সমিতির বিভিন্ন পদে থাকার সময় তাঁরা অর্থ আত্মসাৎ করেন।

ঢাকা ওয়াসা
ঢাকা ওয়াসা

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে কে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, এর বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। সমিতির বিভিন্ন পদে থাকার সময় তাঁরা এই অর্থ আত্মসাৎ করেন।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির আয়ের উৎস গ্রাহকের বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে পানির বিল আদায়ের কাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয়। ‘প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট (পিপিআই)’ কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।

১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে তারা মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে পেয়েছে।

ব্যয় নির্বাহের পর ঢাকা ওয়াসা থেকে কমিশন বাবদ পাওয়া উদ্বৃত্তের সুবিধাভোগী হওয়ার কথা সমিতির সাধারণ সদস্যদের। কিন্তু তাঁদের বঞ্চিত করে ব্যবস্থাপনা কমিটির কেউ কেউ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

তদন্তে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতিতে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। সমবায় আইনের ৮৩ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ আদায় করা যাবে। চাইলে সমিতি মামলাও করতে পারে।
মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, তদন্ত কমিটির প্রধান

অভিযোগ তদন্তে গত বছরের ৬ জুলাই সমবায় অধিদপ্তর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। শেষে সম্প্রতি কমিটি তার প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়েছে।

‘তদন্ত কমিটিকে আমার বক্তব্য জানিয়েছি। সমিতির অর্থনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সিবিএ নেতা হিসেবে সমিতির কয়েকটি সভায় উপস্থিত ছিলাম।’
আসকার ইবনে সায়েক, ঢাকা ওয়াসার সিবিএর সাধারণ সম্পাদক

তদন্ত কমিটির প্রধান মুহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতিতে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। সমবায় আইনের ৮৩ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ আদায় করা যাবে। চাইলে সমিতি মামলাও করতে পারে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে স্পষ্ট যে অর্থ লোপাট করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির নামে। অথচ তা পরিচালনা করেন পিপিআই (সমিতির অধীনে নেওয়া একটি প্রকল্প) পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান। সমিতির নামে ব্যাংক হিসাব খুলে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তা পরিচালনা করা সমবায় সমিতি আইনের পরিপন্থী।

কে কত টাকা নিয়েছেন

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার সিবিএর সাবেক সভাপতি প্রয়াত হাফিজ উদ্দিন একাই আত্মসাৎ করেছেন ৪৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাম্পচালক শামসুজ্জামান ১৩ কোটি ৩৫ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক ছিদ্দিকুর রহমান ১২ কোটি ৯৭ লাখ, আশরাফুল আলম ১১ কোটি ৪৯ লাখ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান ভূঁইয়া ১১ কোটি ৪৯ লাখ, সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ৯ কোটি ৫৬ লাখ, ওয়াসা সিবিএর সাধারণ সম্পাদক আসকার ইবনে সায়েক ৬ কোটি ৬৮ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ৬ কোটি ৬৭ লাখ, সফিকুল ইসলাম ৬ কোটি ৬৭ লাখ এবং গাড়িচালক সংঘের সভাপতি বাবুল আলী ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করেছেন ৪ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত।

তদন্তে অর্থ আত্মসাতে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সঙ্গে তদন্ত কমিটি কথা বলেছে। তারপরই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সিবিএর সাধারণ সম্পাদক আসকার ইবনে সায়েক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটিকে আমার বক্তব্য জানিয়েছি। সমিতির অর্থনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সিবিএ নেতা হিসেবে সমিতির কয়েকটি সভায় উপস্থিত ছিলাম।’

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের কয়েকজন এর মধ্যে মারা গেছেন। কয়েকজন অবসরে। অন্যরা চাকরিরত।

সমিতির টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, জানতে যোগাযোগ করা হয় সংস্থাটির উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগের সঠিকতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘অর্থ আত্মসাতের ফলে সমিতির সাধারণ সদস্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’
শাহাব উদ্দিন সরকার, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক

তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা

এদিকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর সমিতির তিনজনের বিরুদ্ধে গত ১০ মে মামলা করেছে দুদক। আসামিরা হলেন সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মিঞা মো. মিজানুর রহমান, হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া ও কম্পিউটার অপারেটর নাইমুল হাসান।

দুদকের মামলার আসামি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, দুদকের মামলার অপর আসামি হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা ও নাইমুল হাসান ১ কোটি ৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ আত্মসাতের ফলে সমিতির সাধারণ সদস্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’