‘নিজেকে এখন আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমিও পারব।’ বেশ দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলছিলেন ১৭ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন। আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোর এক দিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এ কথা বলেন রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আয়েশা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করে নেতৃত্ব দেওয়ার মনোভাব তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি আয়েশাকে নিয়ে এই আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন উপলক্ষে ৭ অক্টোবর থেকে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ‘গার্লস টেকওভার’ নামের বৈশ্বিক প্রচারাভিযান চালাচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে একজন মেয়েশিশুর ওপর দায়িত্ব দেওয়ার এই প্রচারাভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রথম আলোর সম্পাদক পদের দায়িত্ব নেন আয়েশা। বেলা ২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত কার্যালয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পাদকের পরিচয়পত্রের কার্ড পরিয়ে দেন আয়েশাকে। পরে আয়েশা সম্পাদকের চেয়ারে বসে দিনের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান।
মতিউর রহমান প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণ, অনলাইন (বাংলা ও ইংরেজি), সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম আলোর পেজ, ভিডিও বিভাগ, প্রথম আলোর বিভিন্ন সাময়িকী সম্পর্কে ধারণা দেন।
মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলো ২৪ ঘণ্টা ধরে চলে। ছাপা পত্রিকার জন্য দিনজুড়ে কাজ চলে। পরদিন ছাপা সংস্করণ পৌঁছে দেওয়া হয় পাঠকের হাতে। তবে পাঠক ২৪ ঘণ্টা প্রথম আলোর খবর জানতে পারেন অনলাইন থেকে। তিনি আরও বলেন, সম্পাদক হলে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যাতে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কোথাও ভুল না হয়।
সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা আয়েশা জানান, পাঠক হিসেবে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত আছেন। সারা দিনের সব খবর সংগ্রহ করে পাঠকের কাছে উপস্থাপনের দিকটা তাঁর ভালো লাগে। তিনি নারী ও শিশুর অধিকারবিষয়ক সংবাদ প্রকাশে আরও জোর দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রথম আলোর নারী কর্মীর সংখ্যা পুরুষের সমানসংখ্যক করারও আহ্বান জানান তিনি।
আয়েশাকে প্রথম আলোর বার্তা, ফিচার, সম্পাদকীয়, সম্পাদনা, ইংরেজি বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ পরিদর্শনে নিয়ে যান প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বর্ণনা করেন, প্রথম আলো কীভাবে সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে তা পরিবেশন করে এবং নির্ভুলভাবে প্রকাশের জন্য কী কী উদ্যোগ নেয়।
বেলা তিনটায় বার্তা বিভাগের সঙ্গে এক সভায় যোগ দেন আয়েশা খাতুন। সভায় আরও অংশ নেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি , বার্তা সম্পাদক রাজীব হাসান, হেড অব রিপোর্টিং টিপু সুলতান, আঞ্চলিক সংবাদবিষয়ক সম্পাদক তুহিন সাইফুল্লাহ, বাণিজ্য সম্পাদক সুজয় মহাজন, সহকারী বার্তা সম্পাদক দাউদুল ইসলাম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার রাজীব আহমেদ, সহকারী বার্তা সম্পাদক আবুল হাসনাত।
এরপর আয়েশা যোগ দেন প্রথম আলোর বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘বিজ্ঞানচিন্তা’র অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বপ্ন পূরণের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ জরুরি। লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার যে লড়াই করা প্রয়োজন, তার জন্য আত্মবিশ্বাসও জরুরি। প্রথম আলোর সম্পাদক পদে সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব নেওয়াও তাঁর মধ্যে স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা বাড়িয়েছে বলে জানান আয়েশা। তিনি নার্স হয়ে দরিদ্র মানুষের সেবা করতে চান।
চার বছর বয়সে আয়েশা তাঁর বাবা কাজল মৃধাকে হারান। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আলেয়া বেগম চার মেয়েকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াই করেন। বোনদের মধ্যে আয়েশা সবার ছোট। রাজধানীর ধলপুরে মা ও তৃতীয় বোনের সঙ্গে থাকেন আয়েশা। বড় বোন তাঁর পরিবার নিয়ে পাশেই থাকেন। মেজ বোন নিজ সংসারে আলাদা থাকেন। তিন বোন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ছেন এবং পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। আয়েশা জানান, তিনিও দুটি শিশুকে পড়িয়ে আয় করেন।
আয়েশার সঙ্গে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (প্রভাববিস্তার, প্রচারাভিযান ও যোগাযোগ বিভাগ) নিশাত সুলতানা। তিনি বলেন, বিশ্বের ৮০টি দেশে কাজ করছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ অনেকগুলো দেশে ‘গার্লস টেকওভার’ প্রচারাভিযান চলছে। এ প্রচারাভিযানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মেয়েরা যেন স্বপ্ন দেখতে পারেন। প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারবেন।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক আরিফ আহমেদ জানান, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেয়েদের নেতৃত্বের স্থানে যাওয়ার স্বপ্ন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে তাঁদের এবারের প্রচারাভিযানে প্রথম আলোর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত, মাইক্রোসফট বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান—তিন দেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্রু ভ্যালু নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পদে এক দিনের দায়িত্ব পালন করেছেন মেয়েরা।
সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ দিকে আয়েশা বলেন, শিক্ষা মেয়েদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনে। তাই মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। ফলে সমাজে জেন্ডার–অসমতা কমে আসবে।