নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন। গত তিন বছরে মিলেছে কেবল ৮০ কোটি টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়নে আড়াই বছর আগে ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। বড় বাজেটের এই প্রকল্প অনুমোদন দিলেও গত অর্থবছরে সংস্থাটিকে মাত্র ৮০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো টাকাই দেওয়া হয়নি। এতে পিছিয়ে পড়া এসব ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, নতুন ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজ চালিয়ে নিতে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল সরকার। এই টাকা চার ধাপে দেওয়ার কথা। সে অনুযায়ী প্রথম ধাপে (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে) ৭৫ কোটি টাকা ছাড়ের অনুরোধ করা হয়েছিল সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। তবে এই টাকা ছাড় দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সম্মতি দেয়নি।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশে কৃচ্ছ্রসাধন করতে গিয়ে আপাতত ভূমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দ বন্ধ থাকবে—এই তথ্য জানিয়ে কয়েক দিন আগে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই চিঠি পেয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাল্টা চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছেন নাগরিক সেবার দিক থেকে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড অনেক পিছিয়ে আছে। তাই পিছিয়ে পড়া এসব ওয়ার্ডের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পটি যেন কৃচ্ছ্রসাধনের আওতায় না পড়ে।
গত রোববার তুরাগ থানাধীন বামনারটেক মেইন রোড ঘুরে দেখা গেল, শীতের মৌসুমেও এই সড়কের বেশির ভাগ স্থানে পানি জমে আছে। ইট বিছানো সড়ক খানাখন্দে ভরা। ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে যানবাহন। ধরাঙ্গারটেকসহ আশপাশের এলাকার সড়কেরও একই অবস্থা।
বামনারটেক ও ধরাঙ্গারটেক এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই এলাকায় কোনো সরকার নেই। সব রাস্তাঘাট ভাঙা। অনেক দিন ধরেই লেখালেখি হচ্ছে। তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।’
৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের মতো নতুন যুক্ত হওয়া বাকি ওয়ার্ডগুলোরও কমবেশি একই অবস্থা। যেমন ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়ার্ডের সব সড়ক ভাঙাচোরা। অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিনিয়ত বাসিন্দাদের তোপের মুখে পড়ছি।’
নাগরিক সেবা বাড়াতে, ২০১৬ সালের ২৮ জুন পুরোনো হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণ খান, বাড্ডা, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড গঠন করা হয়। পরে ১১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হলেও এসব এলাকার বাসিন্দারা এখন পর্যন্ত প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন না।
ঢাকা উত্তর সিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে প্রথম পর্যায়ের উন্নয়নকাজের জন্য ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকা অনুমোদন করে। অনুমোদিত টাকার মধ্যে ১ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে। আর ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নকাজের উদ্বোধন করেন। তবে প্রকল্প অনুমোদনের পর গত তিন অর্থবছরে উত্তর সিটিকে এখন পর্যন্ত ৮০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তাই অর্থসংকটের কারণে পুরোদস্তুর উন্নয়নকাজ শুরু করা যায়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় ১৮২ কিলোমিটার সড়ক, ২৩৪ কিলোমিটার নর্দমা ও ২৮ কিলোমিটার খাল উন্নয়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্ধকার সড়ক আলোকিত করতে সড়কবাতি লাগানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ১১৫ কিলোমিটার সড়ক ৮ থেকে ১৮ ফুট করার পরিকল্পনা ছিল। দুই লেন করার কথা রয়েছে ৪৩ কিলোমিটার সড়ক। আর চার লেন করার কথা ২৫ কিলোমিটার সড়ক। তবে ১১৫ কিলোমিটার সড়ক এলাকাভেদে ৮ থেকে ১৮ ফুট করার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে ওই সব সড়ক ২০ ফুট চওড়া করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বরাদ্দ পাওয়া টাকা দিয়ে তুলনামূলক অনুন্নত এলাকায় কাজ শুরু করা হয়েছে। নগর–পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে চওড়া সড়ক, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসাকেন্দ্র, শরীরচর্চা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার, কমিউনিটি সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, নাট্যমঞ্চ, খেলার মাঠ, পার্ক, পশু জবাইখানা, গণশৌচাগার ও বাস টার্মিনাল থাকা আবশ্যক। অথচ নতুন ওয়ার্ডগুলোতে এসবের কিছুই নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামো তৈরির পেছনে সরকার বৃহৎ অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে।
সেই তুলনায় নাগরিকদের মৌলিক সেবা কমিউনিটিভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে তেমন বরাদ্দ দেওয়ার আগ্রহ দেখায় না। এ জন্য সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় থেকেও নগরবাসীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খুব দ্রুত টাকা ছাড় দেওয়া উচিত বলে মনে করি।’