কোরবানির জন্য কেনা ছাগলকে কাঁঠালপাতা খাওয়াচ্ছে একটি শিশু। গতকাল রাজধানীতে
কোরবানির জন্য কেনা ছাগলকে কাঁঠালপাতা খাওয়াচ্ছে একটি শিশু। গতকাল রাজধানীতে

শখের রাখাল, মৌসুমি গোয়াল

গরু-ছাগলের মতো গবাদিপশুর দেখা শহরে তেমন মেলে না। দেখা যায় তাদের চামড়া ছাড়ানো শরীরের বিভিন্ন টুকরা। লোকে ওজনের মাপে কিনে আনে। অবশ্য এর দর এতই চড়া যে দৃষ্টি ছুঁয়ে গেলেও স্পর্শ করার সামর্থ্য অধিকাংশেরই নেই। তবে এখন চলমান গবাদিকুলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর রাজপথ থেকে অলিগলিতে।

বহু দূরের নিভৃত পল্লি, মন্থর মফস্‌সল শহর থেকে এসব গবাদিপশু আসছে ঢাকায়। রাজধানীর রাজপথে জরির মালা, শিংয়ে রাংতার সাজে সুসজ্জিত যেসব গরু-ছাগলের গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে; এদের তোলা হয়েছিল কোরবানির হাটে। সেখানে দরদাম করে ব্যাপারীদের হাওলা থেকে কোরবানিদাতার কাছে সোপর্দ। তারপর হাট থেকে গবাদিপশুগুলোকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। দৃশ্যটি তর্কালঙ্কার মহাশয়ের বলা ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’র সঙ্গে খাপে খাপে না মিললেও মেঠো পথের বদলে পিচঢালা সড়কে গরুর পিছু শৌখিন রাখালদের ছুটতে দেখে গ্রামীণ জীবনের স্মৃতি জাগতে পারে অনেকের মনে।

কোরবানির এসব গবাদিকুলের পরিভ্রমণটা দাঁড়াল তাহলে—গ্রামের গোয়াল থেকে রাজধানীর ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’। সেখান থেকে শহুরে ফ্ল্যাট বাড়ির গ্যারেজ বা অভিজাত আবাসনের সামনের ফুটপাতে তৈরি করা ‘মৌসুমি গো-নিবাস’। ধানমন্ডি, গুলশানের মতো কিছু কিছু এলাকায় দেখা গেল ফুটপাতে এমন চমৎকার করে ত্রিপলের ছাউনি, চাঁদোয়া, শামিয়ানা, দণ্ডায়মান বৈদ্যুতিক পাখা সহযোগে কোরবানির গরু-ছাগলের আবাসন তৈরি করা হয়েছে যে সেগুলোকে নেহাত ‘গোয়াল’ বললে মর্যাদায় খাটো করা হয়। তাই ‘গো-নিবাস’ বলা।

প্রতিবছর এই হয়। পশুপ্রেম যতই থাক না কেন, ঢাকা তো দুরস্ত, অনেক জেলা শহরের বাড়িতেও পশু পালনের পরিসর নেই। কৃষিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্প্রসারিত হয়েছে তৃণমূল অবধি। ফলে চাষাবাদের জন্য গরু-মহিষ পালনের প্রয়োজনীয়তা কম। আর মালামাল টানার জন্য গরু-মহিষের গাড়ি বহু বছর আগেই বিলুপ্ত। ওদিকে গ্রামীণ কলুরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ত্যাগ করেছেন। ফলে ঘানি ঘোরানো থেকে রেহাই মিলেছে ‘বলদ’ সম্প্রদায়ের। এখন মাংস ও দুধের বাণিজ্যিক উৎপাদনের নিমিত্তেই গবাদিপশুর লালন-পালন করা হয়। তারা খামারে জন্মে। সেখানেই দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে থাকে। খায়দায় আর জাবর কেটে মোটাতাজা হয়ে ওঠে। মাঠে চড়ে বেড়ানোর সুখ না থাকলেও খামারে যত্নআত্তির ঘাটতি নেই। ভালো খাবার, গরমে বৈদ্যুতিক পাখা—সব ব্যবস্থাই বলবৎ। হয়তো অতটা ভরপেট খাবার, অতটা আলো-হাওয়া থাকে না খামারের পরিচর্যাকারী শ্রমজীবীর সংসারে।

জীবনানন্দ দাশ একবার তো বলেছিলেন, ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’। সত্যি তো, মানুষের জীবন আর অপর প্রাণীর জীবন এক প্রকার নয়। প্রাণীর পরিচর্যা করলেও মানুষের কাছে শেষাবধি তা সম্পদ বই কিছু নয়। যথেষ্ট দামি সম্পদও বটে। পত্রপত্রিকায়, ইলেকট্রনিক মাধ্যম, অন্তর্জালের সামাজিক মাধ্যমের পাতা এখন তাদেরই ছবিতেই ভরা। দরদাম, নাম-ঠিকানা নিয়ে হরেক রকম খবর। পথ চলতে তাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যেমন, তেমনি ডাকাডাকিও কানে আসছে। রিকশা-ভ্যানে বোঝাই হয়ে যাচ্ছে কাঁঠালপাতা। কাঁচাবাজারে ফুটপাতের আম, কাঁঠাল, লিচুর পাশে বিকোচ্ছে কাঁচা ঘাস। পাড়ার মোড়ের মুদিখানার ধারে বসে গেছে খড়-বিচালি, খুদ-কুঁড়ার পসরা। গ্রামীণ আবহ চলে এসেছে আধফাঁকা ঢাকা শহরে।

নিজের পালন করা পশু কোরবানি করাই উত্তম। সময় ও পরিবেশ উভয়সংকটেই পালিত পশু কোরবানির উপায় নাগরিকদের নেই। সব কোরবানিদাতাকেই নির্ভর করতে হয়ে পশুর হাটের ওপর। সেখান থেকে কেনা পশু বাড়িতে এলে বড় আনন্দ হয় ছোটদের। ভয়ে ভয়ে কাছে যায় তারা। কৌতূহলমাখা দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে গরু-ছাগলের খড়-ভুসি আহার, লেজ নাড়ানো আর জাবর কাটা।

সাহসী হয়ে কেউ কেউ একটু কাছে গিয়ে ওদের গায়ে আদরমাখা হাত বোলানোর চেষ্টা চালায়। বালতি বা গামলায় খাবার এগিয়ে দেয়। ছাগলের মুখে বাড়িয়ে ধরে কাঁঠালপাতা। খুব বেশি লম্বা সময় নয়, দু-এক দিনই মাত্র। মানুষের মন তো, এর মধ্যেই একরকমের মায়া পড়ে যায়। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মায়ার জিনিস, ভালোবাসার বস্তু নিবেদন করাই সর্বোত্তম। তিনি শুধু ভালোবাসাই গ্রহণ করেন।