খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টার

১ বছরের কাজ ১৭ বছরেও শেষ হয়নি

কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ভবনটির নির্মাণকাজ ২০০৬ সালে শুরু হয়েছিল
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

চারতলাবিশিষ্ট ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। উদ্দেশ্য—কমিউনিটি সেন্টার করা। এক বছরের মধ্যে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৭ বছরেও তা শেষ হয়নি। অসমাপ্ত ভবনটি এখন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

ভবনটির অবস্থান রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকায়। সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা প্রথম আলোকে বলেন, অসমাপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় ভবনটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। তাই সংস্কার করে নতুনভাবে ভবনটি নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব (প্রাক্কলন) তৈরি করা হয়েছে। এখন ভবনটির পুরো কাজ শেষ করতে আরও প্রায় ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা লাগবে। অর্থ বরাদ্দের জন্য তাঁরা কয়েক দফায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

অসমাপ্ত ভবনটির অবস্থান রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকায়

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ভবনটি নির্মাণের উদ্যোগ যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন পুরো কাজ শেষ করতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল প্রায় ছয় কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নির্মাণ শুরুর পর ২ কোটি ৭২ লাখ টাকার কাজ করেছে। এর মধ্যে তারা ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বিল নিয়েছে। তহবিল সংকটের কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে বাকি টাকা দিতে পারেনি অধিদপ্তর।

১৪ মার্চ সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটির মূল অবকাঠামো তৈরির কাজ শেষ। তিনতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাইয়ের কাজও শেষ। তিন তলার ওপরে একাংশে চারতলা পর্যন্ত কিছুটা কাজ হয়েছে। ভবনের চারপাশে দেয়াল, ফিনিশিংসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাকি। ভবনটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ভবনের নিচতলা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নিচতলায় কয়েকজন ব্যক্তি বাঁশ রেখে ব্যবসা করছেন। ভবনের সামনের অংশে ইট দিয়ে ঘর তৈরি করে হোটেল চালু করা হয়েছে। রাতে ভবনের ভেতরে মাদক সেবনসহ অসামাজিক কার্যক্রম চলে বলে স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন পড়ে থাকার একপর্যায়ে ভবনটি দখল করে নানা ধরনের ব্যবসা চালু হয়। ২০১৫ সালে ভবনে থাকা তুলার অবৈধ গোডাউনে আগুন লাগে। এতে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুদিন পর ভবনে আসবাবপত্রের দোকানপাট দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন দখলদারেরা। এ নিয়ে ২০১৯ সালে প্রথম আলোয় ‘কমিউনিটি সেন্টার দখল’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের কিছুদিন পর ভবন থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। এখন ভবনটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনের নিচতলায় দুই ব্যক্তি বাঁশের ব্যবসা করছেন।

গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল

ভবনের পুরো কাজ শেষ না হওয়ার কারণ জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার–দলীয় জোট সরকারের সময় ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আসে এক–এগারো। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। অস্থিরতাসহ ক্ষমতার এমন পালাবদলের কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ আর শেষ হয়নি।

খিলগাঁওয়ের যে এলাকায় ভবনটির অবস্থান, তা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। জানতে চাইলে এই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ওয়াহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক–এগারোর পর কাজে ঢিলেমি দেওয়া হয়। ঠিকাদারের বিলও আটকে যায়। পরে কাজই বন্ধ হয়ে যায়।’

এ বিষয়ে জানতে আজ রোববার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

অসমাপ্ত ভবনটি এখন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে

ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তহবিলে টাকা না থাকার কারণে ঠিকাদারকে প্রাপ্য বিল দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। একপর্যায়ে ঠিকাদার আদালতে যান। পরে আইনি নানা জটিলতায় ভবনের নির্মাণকাজ নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায়নি।২০১৬ সালের দিকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ভবনটির বাকি কাজ শেষ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও ভবনের জন্য সরকারি বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তাই ভবনটি এখনো অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে খিলগাঁও এলাকার সংসদ সদস্য ও গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ছিলেন মির্জা আব্বাস। তিনি ১৬ মার্চ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বিএনপি সরকার ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেছে, আর খালেদা জিয়া উদ্বোধন করেছেন, এটা নিয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যত গাত্রদাহ। এ কারণেই নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ, ভবনটিতে কমিউনিটি চালু হলে এলাকার মানুষের উপকার হতো।

অসমাপ্ত অবস্থায় ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এই এলাকায় একটা কমিউনিটি সেন্টার ছিল, মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায়। সেটাও র‍্যাব-পুলিশের দখলে চলে গেছে। তাই রাজনৈতিকভাবে চিন্তা না করে এলাকার মানুষের উপকারের কথা ভেবে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ করা উচিত।’

রাজনৈতিক কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেন এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। তাঁর ভাষ্য, রাজনৈতিক বিবেচনায় ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ হলে তিনি উদ্যোগ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করতেন না। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে এই ভবনের বাকি কাজের জন্য বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। আবার বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।