ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের ঋণছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় নির্মাণকাজ নিয়ে অংশীদারি বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এই প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড ও চীনভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার।
প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি এবং চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
উড়ালসড়ক নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালথাই। এতে অংশীদার ওই তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পটির মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ (ভিজিএফ) নামে পরিচিত।
প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৫ হাজার ৫৯ কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার ৩০০ (৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে ৪ হাজার ৩৮৯ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজারসহ (৪০ কোটি ডলার) মোট ৯ হাজার ৪৪৮ কোটি ৯৮ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ (৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার) টাকার ঋণচুক্তি করে। ঋণবিষয়ক এ চুক্তিতে এক্সিম ও আইসিবিসির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সিটি ব্যাংক এনএর ঢাকা শাখা। ইতিমধ্যে মোট ঋণ ছাড় হয়েছে ৫ হাজার ১৩৬ কোটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ৯৯ টাকা (৪৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার)।
এফডিইই জানিয়েছে, চুক্তি অনুসারে এফডিইইর ব্যাংককে ১৭ বছর ধরে ৭ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ার কথা।এরই মধ্যে ব্যাংক ১২ কিস্তিতে ঋণ ছাড় দিয়েছে। ১৩তম কিস্তিতে ঋণ আটকে যায়। সেটা ১৭ জানুয়ারি দেওয়ার কথা ছিল। চুক্তিতে ছিল, ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে এবং সে পর্যন্ত এক্সিম ও আইসিবিসি ব্যাংক ঋণ দেবে। এখন কোভিড, জমি অধিগ্রহণ, নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ব্যাংক সময় বাড়াতে রাজি নয়। তারা ঋণছাড় করবে না বলেও জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুসারে বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা আছে। প্রকল্পে দলবদ্ধভাবে কাজ হচ্ছে। ফলে ঋণ ছাড় না হওয়া বা অন্য কোনো কারণে এক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হলে অন্যরা অর্থের ব্যবস্থা করবে। ফলে কাজ থেমে যাবে না। পুরো প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে।
আর এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরিক ভাস্কন খান্নাভা ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রকল্পের জন্য এখন বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে কম সময়ের জন্য ছোট ঋণ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটা এ দেশের কোনো ব্যাংক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত দেরি হতে পারে।
বিনিয়োগকারী চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দাবি, শুধু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারা বিষয় নয়। ব্যাংকঋণের সুদ পরিশোধে (পে ব্যাক) ইতালথাইয়ের ব্যর্থতার কারণেও ব্যাংকঋণ আটকে দিয়েছে। ইতালথাই নিজেদের অংশের অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। ব্যাংক বলে দিয়েছে, (এফডিইইকে) ৬ মাসের মধ্যে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নয়তো ইতালথাইকে তাদের শেয়ারের ৯৯ শতাংশ বিক্রি করে দিতে হবে। ব্যাংকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন কোর্টে অভিযোগ করেছে ইতালথাই।
উল্লেখ্য, ব্যাংকঋণের জন্য চুক্তি ২০১৯ সালে হলেও ঋণ ছাড় হয়েছে ২০২০ সালে। চুক্তি অনুসারে, ঋণ ছাড়ের পর ছয় মাস অন্তর অন্তর সুদ পরিশোধ করতে হবে। তিনটি প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম সুদ পরিশোধ করে। আর কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে।
তবে চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন এফডিইইর আইনবিষয়ক উপদেষ্টা ও ইতালথাইয়ের আইনজীবী শারীণা মুজাহিদ চৌধুরী। এফডিইইর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গত ২২ জানুয়ারি ঋণের সুদ পরিশোধ হিসেবে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ২১৯ কোটি ৪৮ লাখ ৮৬ হাজার (২ কোটি ডলার) টাকা দেওয়ার কথা ছিল ব্যাংককে। ইতালথাই বলেছিল ব্যাংক যে ঋণ ছাড় করবে, সেখান থেকে তার অংশটুকু (সুদ পরিশোধের অর্থ) এফডিইইকে বুঝে নিতে। এর আগেই ১৭ জানুয়ারি ঋণছাড় বন্ধ করে ব্যাংক। তিনি বলেন, এ ধরনের বড় প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার সময় ও নির্মাণকাজের সময় বাড়ানো স্বাভাবিক ঘটনা। ঋণদাতারা এ ক্ষেত্রে অযৌক্তিক আচরণ করছে।
শারীণা মুজাহিদ জানান, দুটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠান সমস্যা সমাধানের চেয়ে ইতালথাইয়ের শেয়ার নিতে আগ্রহী বেশি। সেটা ঠেকাতে বাংলাদেশের হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করা হয়। এর বিরুদ্ধে একটি চীনা অংশীদারি প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে আবেদনও করে। তবে আদালত সেটি বাতিল করে দিয়েছেন।
এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাস্কন খান্নাভা বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হবে না। পুরোটা নির্মাণ না হলে সেই পরিমাণ আয়ও হবে না আমাদের। ইতালথাই শেয়ার ছাড়বে না। এই প্রকল্প থেকেও সরবে না। অন্য দুটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্যাংডন ও সিনোহাইড্রো অন্যায় ও অনৈতিকভাবে শেয়ার নেওয়ার চেষ্টা করছে।’
২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালে নির্মাণের চুক্তি হয়। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। উড়ালসড়কটির আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।