তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কেউ নন। কিন্তু ব্যবহার করেন করপোরেশনের ৬০ লাখ টাকা দামের গাড়ি। তাঁর জন্য নিয়োজিত আছেন একজন চালক ও দুজন অফিস সহায়ক। বসেন মেয়র কার্যালয়ের নিচতলায় প্রটোকল কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে।
করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গোলাম মোর্শেদ নামের এই ব্যক্তি নিজেকে দক্ষিণ সিটির মেয়রের প্রটোকল কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলেও এই পদবি লিখেছেন। তিনি যে গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো ১৩-৩৩৮২) ব্যবহার করেন, সেটিও প্রটোকল কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ।
তার আগে সর্বশেষ এই গাড়িটি (ডাবল কেবিন পিকআপ) ব্যবহার করেছিলেন মেয়রের প্রটোকল কর্মকর্তা দাউদ হোসেন। প্রায় এক বছর আগে তিনি বদলি হয়ে যান। এর কয়েক দিন পর থেকে গাড়িটি ব্যবহার করছেন গোলাম মোর্শেদ। এই গাড়ির জ্বালানির বাবদ মাসে খরচ হয় ৫০ হাজার টাকার বেশি।
গোলাম মোর্শেদ কীভাবে দক্ষিণ সিটির অফিস কক্ষ ও গাড়ি ব্যবহার করেন, তিনি কোনোভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কি না; নানাভাবে চেষ্টা করেও এ বিষয়ে করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সচিবের দপ্তর ও হিসাব বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, গোলাম মোর্শেদ নামে কাউকে প্রটোকল কর্মকর্তার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। করপোরেশন থেকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একসময়ের বাংলার বাণী পত্রিকার ব্যবস্থাপক ছিলেন গোলাম মোর্শেদ। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠা ছিলেন। গোলাম মোর্শেদ দীর্ঘদিন ধরে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে রয়েছেন। তাই তাঁর বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না।
এ বিষয়ে জানতে গত তিন মাসে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করা হয়। তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছেন। এর মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর তাঁর অফিস কক্ষে গিয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে যে জিজ্ঞাসা করা হবে, সেটা তাঁকে আগে জানানো হয়নি। তাই এ নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে তাঁর সময় লাগবে। কয়েক দিন পর ফোন করার পরামর্শ দেন তিনি।
এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর আবার অফিসে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে জানান, এ বিষয়ে পরে আলাপ করবেন। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর ফোন করা হলে অন্য অজুহাত দেখিয়ে লাইন কেটে দেন। আড়াই মাস পর গতকাল মঙ্গলবার রাতে আবার ফোন করা হলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তাঁর জানামতে গোলাম মোর্শেদের নামে কোনো গাড়ি বরাদ্দ নেই। তিনি এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাননি।
তবে সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন যে গোলাম মোর্শেদ প্রটোকল কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ করা গাড়িটি ব্যবহার করেন।
এই পদে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা বিসিএস নবম গ্রেডের কর্মকর্তা।
গোলাম মোর্শেদ দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন পার্কে অবৈধভাবে রাইড (বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম) বসানো, বিভিন্ন পার্ক ও খেলার মাঠে কফি শপ ও গণশৌচাগারের ইজারা নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে ছোটখাটো পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রভাব রয়েছে বলে করপোরেশনের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বাইরের একজন ব্যক্তিকে এভাবে সিটি করপোরেশনের সুযোগ–সুবিধা দেওয়াকে ক্ষমতার অপব্যবহারের একটা দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রটোকল কর্মকর্তার কক্ষে বসে ওই ব্যক্তি যা করছেন, তা অবৈধ। এর দায়দায়িত্ব সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।
করপোরেশন থেকে নিয়োগ দেওয়া না হলেও তিনি কীভাবে প্রোটোকল কর্মকর্তার কক্ষ ও গাড়ি ব্যবহার করেন, এ বিষয়ে জানতে গত সাড়ে তিন মাসে একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে কল দেওয়া, খুদেবার্তা পাঠানোসহ নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।