‘বাড়ি থেকে কোনো জায়গায় গেলেই আম্মু আম্মু করত। আজকে আমি হাসপাতালের ভেতরে বইয়া বইয়া কান্দি, পোলায় আমারে জিগাইতেও পারে না।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চারতলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) মেঝেতে বসে কাঁদছিলেন আর এসব কথা বলছিলেন সেলিনা বেগম। তাঁর ছেলে জাহান সরদার (২০) রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে পুড়ে এখন এই আইসিইউতে ভর্তি। তাঁর শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে।
জাহান সরদার ঢাকার নবাবগঞ্জের সরকারি দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে তিনি রাজধানীর শনির আখড়ায় থাকতেন। সেলিনা বেগম-জাহাঙ্গীর আলম দম্পতির একমাত্র ছেলে জাহান। তাঁদের এক মেয়ে আছে। বোনের ৯ বছরের ছোট জাহান।
বিলাপ করতে করতে সেলিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক সাধনার পরে ছেলেরে পাইছি। একটু দোয়া কইরো বাবা। দোয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই।’
সপ্তাহখানেক আগে ছেলের সঙ্গে একটি ছবি তুলেছিলেন সেলিনা বেগম। নিজে থেকেই সেই ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে ছেলের ছবি। আট দিন আগের ছবি। পোলায় নামাজ পড়ে আসছে। বলছি, বাবা, আয় তোর লগে একটি ছবি তুলি।’ একটু পরপর সেই ছবি দেখছিলেন তিনি।
পড়াশোনার পাশাপাশি গত বছরের জানুয়ারি থেকে যাত্রাবাড়ী তাজ মার্কেটে কাজ করতেন জাহান। গত মঙ্গলবার ঘটনার দিন কলেজ থেকে গুলিস্তান যাচ্ছিলেন তিনি। গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর তাজ মার্কেটে গিয়ে এক বেলা কাজ করে বাসায় ফেরার কথা ছিল তাঁর। কীভাবে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হলেন, সে কথা মাকে বলেছেন। সেলিনা বেগম বলেন, ‘ও আমাকে বলল, “আম্মু, জ্যাম দেখলাম সামনে। তাই নাইমা গেলাম। নাইমা দুই মিনিটের মতো হাঁটছি। তারপর আমার কী হইছে, বলতে পারব না।”’
সেলিনা বেগমের কান্না মুহূর্তের জন্যও থামছিল না। আইসিইউতে কিছু লাগলে কাঁদতে কাঁদতেই সেই কাজ করছিলেন। কখনো তসবিহ পড়া, কখনো বিলাপ চলছিল তাঁর।
সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে নয়জন বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে তিনজন আইসিইউতে। এই তিনজনের মধ্যে দুজন রয়েছেন লাইফ সাপোর্টে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া সবার অবস্থা খারাপ।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী বাজারে একটি স্যানিটারি দোকানে কাজ করতেন ইয়াসিন আলী (২৬)। দুই মাস আগে সিদ্দিকবাজারের বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানে কাজ নিয়ে ঢাকায় আসেন। বিস্ফোরণে আহত হয়ে এখন তিনি বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে আছেন।
ঢাকায় এসে মগবাজারে মামার বাসায় উঠেছিলেন ইয়াসিন। আইসিইউর বাইরে ছিলেন তাঁর মামি মমতাজ বেগম। আজ দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাক্তার বলছেন, ওর অবস্থা ভালো না।’
বিস্ফোরিত ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে স্যানিটারির দোকান ছিল। এই দোকানের ওপর ওপরের ফ্লোর ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়া ফ্লোরে ইয়াসিনের মাথা থেঁতলে গেছে বলে জানান তাঁর খালাতো ভাই শিব্বির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দোকানে আগুনও লাগছে। ইয়াসিনের শরীরের ৫৫ ভাগ পুড়ে গেছে। মুখ, গলা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কাচে কেটে গেছে।
ইয়াসিনের মা–বাবা বেগমগঞ্জে থাকেন। তাঁর বড় ভাই বিদেশে থাকেন। এ ছাড়া তাঁর দুই বোন রয়েছেন। গতকাল বুধবার সকাল থেকে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে থাকা আরেক ব্যক্তি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের খলিলুর রহমান (৩২)। তাঁর খাদ্যনালি পুড়ে গেছে। মুখ, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ভাঙা কাচও ঢুকেছে তাঁর।
আইসিইউর পাশে বিমর্ষ অবস্থায় তাঁর ছোট ভাই রাহাদুল ইসলাম বসে ছিলেন। তাঁকে ফোনে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়ার অবস্থা ভালো না।’
বিস্ফোরিত ভবনের সামনে ব্যাগের দোকান ছিল খলিলুর রহমানের। সেখানে তাঁর শ্যালক মো. জামাল উদ্দিনেরও দোকান আছে। দুলাভাইকে রেখে নামাজ পড়তে যান তিনি। নামাজে থাকতেই বিকট শব্দের পর তিনি জানালা দিয়ে আগুনের গোলা দেখতে পান। এসে দেখেন তাঁর দুলাভাই নেই। একপর্যায়ে খলিলুর রহমানকে এই ইনস্টিটিউটে খুঁজে পান তাঁরা। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিস্ফোরণে রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে উড়ে যান দুলাভাই।’
ছোট তিন ছেলেমেয়ে রয়েছে খলিলুর রহমানের। সন্তানদের নিয়ে খলিলুর রহমানের স্ত্রী বেগমগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন খলিলুর। তাঁর ছোট ভাই রাহাদুল বলেন, ভাইয়ের আয়ের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল।
সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১২ জন ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রাতে মারা যান মো. মুসা (৪৫)। আর মো. মোস্তফা (৫০) ও কামাল শেখ (৪০) নামের দুজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। এখন আইসিইউতে থাকা তিনজনের বাইরে এই ইনস্টিটিউটে খলিল শিকদার (৫০), আজম (৪০), মো. বাবলু (২৫), আল আমিন (২৪), বাচ্চু মিয়া (৫৫) ও ওলি শিকদার (৫৫) নামের ছয় ব্যক্তি চিকিৎসাধীন।