ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাস।এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর শহরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে।
ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাসের স্তর তৈরি হয়েছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে এসব গ্যাস তৈরি হচ্ছে, যা ঢাকার বাতাস ও মাটিকে আরও উষ্ণ করে তুলছে। তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এসব ক্ষতিকর গ্যাসের কারণে রাজধানীর আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে উঠেছে। একদল বিজ্ঞানীর দুটি সাম্প্রতিক গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাস জমা হচ্ছে, যা শহরবাসীর নানা রোগবালাই এবং সমস্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বাতাসকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত শহরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যাটমসফেয়ারিক কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত গবেষণায় ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাসের অস্তিত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। ‘ঢাকার বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের অস্তিত্ব চিহ্নিত ও পরিমাপকরণ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৬ এপ্রিল।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যাটমসফেয়ারিক কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত গবেষণায় ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাসের অস্তিত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। ‘ঢাকার বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের অস্তিত্ব চিহ্নিত ও পরিমাপকরণ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৬ এপ্রিল।
গবেষণা দলটির অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার বাতাসে দূষণ এবং গ্রীষ্মকালীন উত্তাপের পাশাপাশি গ্যাসের বিপদ কতটুকু, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর মাত্রায় পাঁচ ধরনের গ্যাস পাওয়া গেছে। এসব গ্যাসের উৎসগুলো কমাতে পারলে শহরের বায়ুদূষণ এবং অতি উষ্ণতাকেও নিয়ন্ত্রণ এবং সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে।’
পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত শহরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে।
গতকাল রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আগের দিনের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমেছে। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মূলত গত শনিবারের তুলনায় রোববার সারা দেশে বাতাসের প্রবাহ বেড়েছে। আবার আর্দ্রতাও কমেছে। এ ধরনের আবহাওয়ায় তাপমাত্রা কিছুটা কমে। যেমন ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা শেরপুর ও মাদারীপুরের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে ৩৫ ও ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। কিন্তু ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি থাকলে তাপমাত্রা দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিরিক্ত বাড়ে। আর ওজোন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বাড়লে তাপমাত্রা আরও দশমিক ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। শহর এবং গ্যাসপ্রবণ এলাকাগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ আবহাওয়াগত কারণে কোনো এলাকার তাপমাত্রা যে পরিমাণে বাড়ে তার সঙ্গে ওই গ্যাসগুলো যোগ হলে উত্তাপ আরও বেড়ে যায়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের তাপমাত্রা কমাতে আমরা গাছ লাগিয়েছি। তবে এগুলো বড় হতে সময় লাগবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ২০ হাজার রিকশাওয়ালাকে ছাতা ও পানির বোতল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য দরিদ্র পেশাজীবীদেরও এ ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।’
ঢাকার বাতাসে দূষণ এবং গ্রীষ্মকালীন উত্তাপের পাশাপাশি গ্যাসের বিপদ কতটুকু, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর মাত্রায় পাঁচ ধরনের গ্যাস পাওয়া গেছে। এসব গ্যাসের উৎসগুলো কমাতে পারলে শহরের বায়ুদূষণ এবং অতি উষ্ণতাকেও নিয়ন্ত্রণ এবং সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে।অধ্যাপক আবদুস সালাম, গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক
আরেকটি গবেষণায় এ ধরনের গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ঢাকার ময়লার ভাগাড়গুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ওই গবেষণা করা হয়েছে। এতে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০টি ময়লার ভাগাড় এবং রমনা পার্কের ময়লা ফেলার জায়গাগুলোর ওপর সমীক্ষা করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় ময়লার ডিপো মাতুয়াইল ও আমিনবাজারের ওপর জরিপ করা হয়। আর অস্থায়ীভাবে ময়লা রাখার স্থান হিসেবে গুলিস্তান, ধলপুর, বনশ্রী, হাজারীবাগ, বঙ্গবাজার, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি ও উত্তরার ভাগাড়গুলোতে জরিপ করা হয়। অপেক্ষাকৃত নিয়মতান্ত্রিকভাবে রমনা পার্কের যে জায়গাগুলোতে ময়লা ফেলা হয়, সেখানেও জরিপ করা হয়।
সমীক্ষায় রমনা পার্ক ছাড়া বাকি সব জায়গায় গ্যাসের পরিমাণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পাওয়া গেছে। সেখানকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম–২.৫ ও পিএম–১০ এবং ওই গ্যাসগুলোর পরিমাণ ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। গবেষণার এই ফলাফল গত বছরের নভেম্বরে বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিঞ্জার নেচার–এ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ময়লার ভাগাড়ে গ্যাস নিঃসরণ’ শীর্ষক গবেষণাটিতে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতির বিষয়টি উঠে আসে।
ঢাকা শহরের তাপমাত্রা কমাতে আমরা গাছ লাগিয়েছি। তবে এগুলো বড় হতে সময় লাগবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ২০ হাজার রিকশাওয়ালাকে ছাতা ও পানির বোতল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য দরিদ্র পেশাজীবীদেরও এ ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।’আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র
ওই গবেষণায় মাতুয়াইল ও আমিনবাজার ভাগাড়ে সবচেয়ে বেশি গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বেশি। অন্য ভাগাড়গুলোর তুলনায় ওই দুই জায়গায় গ্যাসের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি পাওয়া গেছে। ওই গ্যাস এবং ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাস উষ্ণ করে তোলার পাশাপাশি বিষাক্ত উপাদান বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটিতে দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে দ্রুত বাড়তে থাকা গ্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড গ্যাস। এ ছাড়া ওজোন গ্যাসের পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে পাওয়া গেছে। সামগ্রিকভাবে ঢাকার বাতাসে মিথেন গ্যাসের পরিমাণও বিপজ্জনক পর্যায়ে পাওয়া গেছে বলে গবেষক দলটির পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে।
ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন গ্যাস গ্রীষ্ম ও বর্ষা এই দুই ঋতুতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। মিথেন গ্যাসের পরিমাণও এই দুই ঋতুতে বেশি পাওয়া গেছে। মূলত যানবাহনের তেল পোড়ানো, ইটভাটা এবং ময়লা–আবর্জনা ফেলে রাখলে তা থেকে এসব গ্যাস তৈরি হয়।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকার বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে অবৈধ ইটভাটা ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে দূষণের কারণে শহরের ক্ষতিকর গ্যাস বেড়ে গেছে।’