ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনই সমন্বিত ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী দিনে আরও ভয়াবহ আকারে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। তিনি বলেছেন, ডেঙ্গু এখন জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণে এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নেতৃত্ব দরকার। বড় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার।
‘ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মীরজাদী সেব্রিনা এ কথা বলেন। রাজধানীর মহাখালীতে নিপসমের সভাকক্ষে আজ শনিবার এ সভার আয়োজন করা হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইপাব)। মীরজাদী সেব্রিনা এই সংগঠনের সভাপতি। তিনি করোনা মহামারির শুরুতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ছিলেন। সেই সময় করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আইইডিসিআরের তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
করোনাকালের সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে আজ মীরজাদী সেব্রিনা বললেন, ‘করোনার নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের অনেকেই অংশীদার। আমি মনে করি কোভিডের (নিয়ন্ত্রণের) সাফল্যের পেছনে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল, তার ১ নম্বর হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা।’ তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু আমাদের জন্য জাতীয় সমস্যা। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নেতৃত্ব দেওয়া না হলে সব মন্ত্রণালয়কে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করাটা কঠিন হবে।’
অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, টিকা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা অংশ নেন। তবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ঢাকার দুই সিটির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। আজ বক্তাদের প্রায় সবাই অভিন্ন মত দেন—এবার ডেঙ্গু যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, সেই তুলনায় এর নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে এটি ছড়িয়ে গেছে। এর নিয়ন্ত্রণ একটি মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। এর জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত আক্রান্ত হয়েছে, এবার এই নভেম্বরের মধ্যে তার তুলনায় সোয়া গুণ রোগী বেশি হয়ে গেছে। আর ২৩ বছরের চেয়ে এবার প্রায় ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, এবার আক্রান্ত রোগীদের ৬০ ভাগ পুরুষ। কিন্তু ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৫৮ শতাংশ নারী। এবার আক্রান্তদের ৬২ শতাংশের বেশি বয়স ৩০ বছরের এর নিচে। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের ৬৪ ভাগের বয়স ৩০ বছরের বেশি।
ডেঙ্গু বিস্তারের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক তুলে ধরে মুশতাক হোসেন বলেন, ২০০০ থেকে ২০১০ সালে দেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক দশকে তাপমাত্রা দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ডেঙ্গুর রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশার বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে।
এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিপরীতে নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা খুব অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তা এস এম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আজ পর্যন্ত কোনো টাস্কফোর্স হয়নি। একটি জরুরি সভা হয়নি। কোনো দেশে ডেঙ্গু শুরু হলে এটি শেষ হয়ে যায় না। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য জরুরি সমন্বিত উদ্যোগ নেই। জনসম্পৃক্ততা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে তেমন করে সহযোগিতাও চাওয়া হয়নি। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আমরা সহযোগিতা করতে সব সময় প্রস্তুত।’
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) মো. আখতারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসম্পৃক্ততা সহজ কাজ নয়। নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা সহজ। কোনো কোনো দেশে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে আইনও আছে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইপাবের সহসভাপতি ইকবাল কবির। স্বাগত বক্তব্য দেন ইপাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রেজা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা স্তরের উদ্যোগ দরকার। এটা শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। এটা এখন সারা বছরের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই এর নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও বহুমাত্রিক পদক্ষেপ দরকার।
অনুষ্ঠানে আলোচকদের মধ্যে ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম, আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক, ইউনিসেফের প্রতিনিধি ইয়াসমিন খান, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম, আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম, নিপসমের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গোলাম ছারোয়ার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারী পরিচালক শ্যামল কুমার দাস, বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান, প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক পার্থ শঙ্কর সাহা।