দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে সংহতি সমাবেশ ডেকেছিল ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। এ সমাবেশে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ আসতে শুরু করলে একধরনের সন্দেহ ও আতঙ্ক তৈরি হয়। পরে পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর তৎপরতায় সেই সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়।
এদিকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের আহ্বায়ককে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, অহিংস গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে মানিকগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও টাঙ্গাইল থেকে লোক জড়ো করার সময় বেশ কয়েকজনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে।
শাহবাগে ওই সমাবেশে যোগ দিতে গত রোববার দিবাগত রাত একটার পর থেকেই একের পর এক বাস, পিকআপ ও মাইক্রোবাসে করে বিপুলসংখ্যক মানুষ শাহবাগ এলাকায় আসতে শুরু করেন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ অনেকের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন প্রচারণা দেখা যায় যে আওয়ামী লীগ টাকা দিয়ে শাহবাগে লোক জড়ো করছে।
এমন পরিস্থিতিতে রাতেই পুলিশ শাহবাগ এলাকায় টহল বাড়ায়। তবু গাড়িতে করে লোকজন আসতে থাকেন। এত মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ে গতকাল সকাল সাতটার দিকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তীব্র যানজট দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় একদল শিক্ষার্থী আগত লোকজনকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন। পুলিশও লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করে। এতে আগত লোকজনের বেশির ভাগই ফিরে যান।
আগত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহবাগে ঠিক কী হবে, তা তাঁরা জানেন না। বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। শাহবাগে যাঁরা উপস্থিত হবেন, তাঁদের এক লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। এ জন্যই তাঁরা শাহবাগে এসেছেন। তাঁদের কয়েকজন এ-ও অভিযোগ করেন, তাঁদের কাছ থেকে নিবন্ধন ফি বাবদ এক হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২২ নভেম্বর অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তিতে ২৫ নভেম্বর (গতকাল) সকাল ১০টায় শাহবাগ চত্বরে সংহতি সমাবেশ করার কথা জানানো হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীনের এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের অনুসমর্থনের ভিত্তিতে একটি বিশেষ আইন প্রণয়নের জন্য চার বছর ধরে কাজ করছে অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ। গত ১৮ আগস্ট শাহবাগ চত্বরে সমাবেশের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর দুর্নীতিবিরোধী এই বিশেষ আইনের খসড়া জমা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল শাহবাগের এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে আসা অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে শাহবাগ থানা-পুলিশ। খবর পেয়ে দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
গতকাল সন্ধ্যায় জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এমন খবর শুনে তিনি শাহবাগ থানায় গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে জনগণকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ আইন করার দাবিতে মোস্তফা আমীন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন। সেই আইনের খসড়া প্রণয়ন করে গণস্বাক্ষরও সংগ্রহ করেছেন। এটা চার বছর ধরে চলছে, এটাকে সেভাবেই দেখা দরকার। আন্দোলনের সঙ্গে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এটিকে যেভাবে একটা ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখানো হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ ভুল বলে আমার ধারণা।’
তবে ঘটনার ব্যাপারে বেশ কয়েকজন আটক আছেন বলে গতকাল রাত পৌনে আটটার দিকে জানান শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর। তিনি বলেন, আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শাহবাগে সমাবেশে এসে প্রতারিত হয়ে গতকাল মানিকগঞ্জ ফিরে ওই সংগঠনের প্রতিনিধি দবির হোসেনের বাড়ি ঘেরাও করেন ভুক্তভোগীরা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। দবির ও তাঁর স্ত্রীকে আটক করেছে পুলিশ।
ভুক্তভোগী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ সংগঠনের প্রতিনিধিরা মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে বিনা সুদে এক লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়ার কথা বলেন। তাঁদের বলা হয়, বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। ঢাকার শাহবাগে যাঁরা যাবেন, তাঁদের এক লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। ঋণের লোভ দেখিয়ে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষকে ছয়টি বাসে করে শাহবাগে নেওয়া হয়।
তাঁদের একজন নাজমা বেগম বলেন, শাহবাগ এলাকায় সমাবেশে গেলে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলে দবির ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের কাছ থেকে ২৫০ টাকা করে নেন।
একই অভিযোগে গতকাল সিঙ্গাইর বাসস্ট্যান্ড থেকে দেলোয়ার হোসেন ও জহুরা বেগম নামের দুজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান সিঙ্গাইর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম।
লক্ষ্মীপুরেও একই অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীপুরে জেলা প্রতিনিধি জানান, রোববার রাতে অহিংস গণ–আন্দোলন বাংলাদেশ একটি সংগঠনের সমাবেশে নেওয়ার জন্য লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও কিশোর-কিশোরীকে জড়ো করা হয়। পরে রাতেই স্থানীয় লোকজন তাঁদের ঘেরাও করে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সাতটি গাড়ি জব্দ করেন। এর মধ্যে তিনটি বাস ও চারটি মাইক্রোবাস। লোভ দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগে ৮৫ জনকে গতকাল সকালে তিনটি থানায় নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় ২৮ জন, রামগতি থানায় ৪৬ ও কমলনগর থানায় ১১ জন আছেন।
টাঙ্গাইল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ১৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাঁদের আটক করা হয়। পুলিশ বলেছে, আটক ব্যক্তিরা বিনা সুদে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রলোভনে নারী ও পুরুষদের নিয়ে গতকাল সকালে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ তাঁদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। জব্দ করা হয় তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাস।
ঢাকায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সংগঠনটির বিরুদ্ধে ঋণের লোভ দেখানোসহ নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংগঠনটির আহ্বায়কসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজনকে আটক করে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।