সারা বিশ্বে প্রায় ৭ কোটি ৬০ লাখ মানুষ গৃহকর্মী পেশায় জড়িত। দেশে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে কেউ বলেন, ২৫ লাখের বেশি, কেউ বলেন দেশে ৭৫ লাখের বেশি গৃহকর্মী আছেন।
এর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী গৃহকর্মী। তবে শহরে বাসাবাড়িতে স্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বা শিশু। গৃহকর্তার সঙ্গে ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মীর কোনো লিখিত চুক্তি নেই।
বিদ্যমান গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি ও আইনের পর্যালোচনা এবং নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় কার্যকর কর্মপরিকল্পনা শীর্ষক কর্মশালায় এসব তথ্য জানানো হয়েছে। আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এটির আয়োজন করে বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা)। এতে বলা হয়, দরিদ্র নারী ও শিশুরা মূলত শহরে আসে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে।
কল্যাণপুর থেকে আসা গৃহকর্মী জোছনা বলেন, ঠিকমতো বেতন আদায় করা যায় না। বাড়তি কাজ করায়, বোনাস দেয় না। তাই আইনি সুরক্ষা দরকার। একই এলাকা থেকে আসা আরেক গৃহকর্মী সাবিহা বলেন, এক কাজের কথা বলে দুই কাজ করায়। একেক এলাকায় একেক রকম বেতন দেয়। যখন-তখন বের করে দেয় চাকরি থেকে। আইন থাকলে এর প্রতিকার সম্ভব হবে।
কর্মশালায় দুটি আলাদা নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মী নিয়োগকর্তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২১ শতাংশ এবং মৌখিক নির্যাতনের শিকার ৬১ শতাংশ। গত বছর প্রকাশিত বিলসের আরেকটি সমীক্ষা বলছে, ৮৪ শতাংশ গৃহকর্মী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তার মানে মাসে তাঁদের আয় গড়ে ৫ হাজার ৩১১ টাকার কম। এ ছাড়া ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৬২৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২২ সালে নির্যাতনে মৃত্যু হয় ১৫ জনের এবং গুরুতর আহত হন ১৮ জন।
অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে বমসা। এতে দেখা যায়, ৩২ শতাংশ গৃহশ্রমিকের মাসে আয় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। ৪৫ শতাংশ নারী গৃহকর্মী তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিবন্ধ বলছে, গৃহশ্রমিকের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে একটি নীতি তৈরি করেছে সরকার। এরপর ৯ বছর হয়ে গেলেও পুরোপুরি এর বাস্তবায়ন হয়নি। এ নীতিমালাকে আইনে রূপান্তরের দাবি জানানো হয় কর্মশালায়।
অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের মহাসচিব মেহজাবিন খালেদ বলেন, নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়া, আইন তৈরি না করাসহ আইনের বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ তৈরির কাজটি করছে ককাস। তাঁরা এটি জাতীয় সংসদে তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সরকারের বিরোধিতা নয়, বরং সরকারকে জনগণের দাবি জানিয়ে সহায়তা করাই এর লক্ষ্য।
সাবেক সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরীন বলেন, নিয়োগকর্তা ও গৃহকর্মী কেউ কারও প্রতিপক্ষ নন। গৃহকর্তাও হত্যার শিকার হন গৃহকর্মীর হাতে। সরকার নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছে। এখন এটি আইনে পরিণত হলে জবাবদিহি ও শাস্তি নিশ্চিত হবে।
শ্রমিকনেতা আবুল হোসেন বলেন, গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। যে নীতিমালা আছে, এটি অনন্য; বিশ্বের কোথাও এমনটা নেই। তবু আইন তৈরির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
বমসার পক্ষ থেকে গৃহকর্মীদের পরিস্থিতি নিয়ে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন আমিনুল হক। এ ছাড়া নীতিমালা ও আইন নিয়ে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরিদা ইয়াসমিন। এতে বলা হয়, গৃহকর্মীদের শ্রম আইনে রাখা হয়নি। তাঁদের জন্য নীতিমালা করা হয়েছে, কিন্তু এটির আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তাই নীতিমালাকে দ্রুত আইনে রূপান্তর করতে হবে। তিনি বলেন, গৃহকর্মীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশই নির্যাতনের কথা জানান না। যাঁরা জানান বা মামলা করেন, সেটিও নানা কারণে ন্যায়বিচার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না। এর মধ্যে দেরিতে মামলা করা, মামলার পর টাকা নিয়ে আপোস করা, গৃহকর্তাদেরও টাকা দিয়ে বা ক্ষমতার জোরে তদন্তে প্রভাব বিস্তার করার বিষয়গুলো আছে।