মারা যাওয়া বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে
মারা যাওয়া বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে

অনেক দিন মূল কাজের লোক নেই প্রাণী জাদুঘরে, প্রভাব সংরক্ষণে

শাবক কোলে বসে মা শিম্পাঞ্জি। পাশে একটি পুরুষ শিম্পাঞ্জি। তবে তারা কেউ জীবিত নয়। মারা যাওয়ার পর চামড়া-মুখমণ্ডল দিয়ে তাদের আগের অবয়ব তৈরি করে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরে।

শিম্পাঞ্জির মতো বনমানুষ, কালো বাঘ, পূমা বা পাহাড়ি সিংহ, উদ, ভল্লুক বিড়াল, বনরুই, টাপির, দৈত্য কাঠবিড়াল, লাদাখী ছাগল প্রভৃতি প্রাণীর অবয়ব এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

জাতীয় চিড়িয়াখানায় এখন আর এই প্রাণীগুলো নেই। এমনকি দেশের কোথাও এগুলো আর দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে মৃত প্রাণী সংরক্ষণ করে সেগুলোর পরিচিতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রাণী জাদুঘরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই জাদুঘরে মৃত প্রাণী সংরক্ষণের কাজ করার মূল জনবলই অনেক দিন ধরে নেই। এর প্রভাব পড়ছে সংরক্ষণে। কয়েক বছর সংরক্ষণ বন্ধ ছিল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশ কিছু অবয়ব নষ্ট হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৃত প্রাণী সংরক্ষণের কাজ করার লোক (টেক্সিডার্মিস্ট) কয়েক বছর নেই। তাই মাঝখানে কয়েক বছর সংরক্ষণ বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি আমরা আবার সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে আমরা কয়েকটি মৃত প্রাণী সংরক্ষণ করেছি।’

যেভাবে সংরক্ষণ

জাতীয় চিড়িয়াখানায় মারা যাওয়া প্রাণী সাধারণত প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রধানত তিনটি উপায়ে প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো হলো স্টাফিং, স্কেলিটন ও স্পেসিম্যান।

স্টাফিং হলো, কোনো প্রাণী মারা গেলে বিশেষ পদ্ধতিতে তার চামড়া ও মাথা সংরক্ষণ করে ফোম–জাতীয় কিছু দিয়ে আগের অবয়ব করা। প্রাণী জাদুঘরে শিম্পাঞ্জি, বনমানুষ, বাঘ, উদ, ভল্লুক-বিড়াল, বনরুই, কালো বাঘ, পাহাড়ি সিংহ, লাল হলুমান, লাল পাণ্ডা, কালোবাস বানর, ম্যাকাউ পাখি, মণিরাজ সাপের মতো ৫৪টি প্রাণীকে স্টাফিং করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অরিক্সের মাথা, জলহস্তীর নিচের চোয়াল, সাম্বার হরিণের মাথা, চিত্রা হরিণের মাথাও আছে।

স্কেলিটন মানে প্রাণী মারা যাওয়ার পর তার হাড় দিয়ে আগের অবয়ব তৈরি করা। প্রাণী জাদুঘরে মাত্র পাঁচটি প্রাণীর স্কেলিটন আছে। এগুলোর মধ্যে দুটি বৃহৎ নীল তিমি, একটি কুমির, একটি মুরগি ও একটি কবুতর আছে।

প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষিত সামুদ্রিক কচ্ছপ

কোনো প্রাণী মারা যাওয়ার পর হুবহু তা কোনো পাত্রের মধ্যে ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণকে বলে স্পেসিম্যান। প্রাণী জাদুঘরে এই পদ্ধতিতে পঙ্খিরাজ সাপ, বংকরাজ সাপ, শকুনের ডিম, গোখরো সাপের ডিম, কচ্ছপের ডিম, হাঙর মাছ, চেল্লা, জোঁক, চিতা বাঘের শাবক, মায়া হরিণ, সামুদ্রিক ছুরি মাছসহ ৭৪টি প্রাণী ও ডিম সংরক্ষণ করা হয়েছে।

পাশাপাশি ময়ূর, উটপাখি, গুইসাপ ও ইমু পাখির ডিমের ভেতরের অংশ ফেলে দিয়ে তা এই জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর মাস কয়েক আগে একটি প্রাণীকে স্পেসিম্যান করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্টাফিং করে সংরক্ষণ করা হয়েছে ছয়টি প্রাণী। তবে এগুলো এখনো প্রদর্শন করা হয়নি। আর অনেক দিন ধরেই বন্ধ আছে স্কেলিটন করা।

মূল কাজের লোক নেই

জাতীয় চিড়িয়াখানায় গত বছর একটি বাঘ মারা যায়। বাঘটিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ জানায়, তখন সংরক্ষণের প্রস্তুতি ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে তারা বাঘটিকে মাটিচাপা দিয়েছে।

এভাবে গত কয়েক বছর চিড়িয়াখানায় মারা যাওয়া প্রাণীদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রাণী জাদুঘরে বর্তমানে মোট ছয়জন কর্মরত। অফিসার ইনচার্জ নামের একটি পদে একজন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি পাঁচজন কর্মচারী। তাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো কাজ করে থাকেন। টেক্সিডার্মিস্ট নামে এখানে দুটি পদ আছে। এর কাজ স্টাফিং, স্কেলিটন ও স্পেসিম্যানের মাধ্যমে প্রাণী সংরক্ষণ করা। তবে এই দুটি পদ কয়েক বছর ধরে শূন্য রয়েছে। ফলে চিড়িয়াখানায় মারা যাওয়ার পর প্রাণী সংরক্ষণের কাজ করার মতো জনবল এখন জাদুঘরে নেই।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেক্সিডার্মিস্ট নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।’

প্রাণী জাদুঘরে দর্শনার্থীরা

প্রাণীর অবয়ব নষ্ট

প্রাণী জাদুঘরে স্টাফিং ও স্পেসিম্যানের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা ৩০টি প্রাণীর অবয়ব নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন এগুলো প্রদর্শনীর অনুপযোগী। এর মধ্যে সাদা হনুমান, উরুক্কু কাঠবিড়াল, চশমা বানরের মতো ১৪টি স্টাফিং করা অবয়ব আছে। আর আছে বিদ্যুৎ মাছ, কেশোয়ারির ডিম, হাড়গিলার বাচ্চার মতো ১৬টি স্পেসিম্যান করা প্রাণী। এ ছাড়া প্রাণী জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, সংরক্ষিত কিছু প্রাণী যথাযথ অবয়ব পায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে তা শত বছর পর্যন্ত ঠিক থাকে। সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা, পর্যাপ্ত পরিচর্যা না করা, দক্ষ লোক না থাকা, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এমনটা (অবয়ব নষ্ট) হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

প্রাণী দেখে বিস্ময়

প্রাণী জাদুঘরে প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।

প্রাণী জাদুঘরে প্রবেশ করতেই ডানে সংরক্ষণ করা আছে ১৬০ কেজি ওজনের একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ। এটি দেখে ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কেরানীগঞ্জ থেকে আসা ইসরাফিল হোসেন মো. ইউসুফ নামের এক খুদে শিক্ষার্থী বলে ওঠে, ‘এত বড় কচ্ছপ!’ সে প্রথম আলোকে বলে, এত বড় কচ্ছপ আগে কখনো দেখেনি।

ময়মনসিংহ থেকে শিক্ষাসফরে এই জাদুঘরে এসেছিল প্লে শ্রেণির ছাত্র হাসান। তার সঙ্গে ছিলেন মা–বাবা। প্রাণী জাদুঘর ঘুরে হাসানের বাবা মোহেইমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে প্রাণীগুলো দেখিনি, সেগুলো এখানে সংরক্ষণ করা আছে। এভাবে প্রাণী সংরক্ষণ করা যায়, তা জানতামই না।’

গবেষণায় অবদান রাখবে সংরক্ষণ

সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ যে কয়েকটি প্রাণী সংরক্ষণ করেছে, সেগুলোর কাজ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা। ৫০০টির বেশি প্রাণীর স্টাফিং ও স্কেলিটন করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।

জুয়েল রানা প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরটির আধুনিকায়ন দরকার। মারা যাওয়া সব প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। প্রতিটি প্রজাতির দুই-তিনটি করে সংরক্ষণ করলেই হয়। সংরক্ষিত প্রাণীগুলো শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকৃতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে প্রাণী জাদুঘর আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেছি। এ ছাড়া প্রাণী জাদুঘর সংস্কারও করা হচ্ছে।’