দেশে ইতিহাসের চর্চা খুব ক্ষীণ পর্যায়ে চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো অনেক বড় নেতা এসেছেন। কিন্তু মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দ্বিতীয় কাউকে আমরা পাইনি। তাঁকে বুঝতে হলে সৈয়দ আবুল মকসুদের বই আমাদের প্রয়োজন হবে।’
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ও তাঁর লেখা ‘ভাসানীচরিত: মওলানা ভাসানীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী’ বইয়ের পাঠ ও পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন। বইটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সৈয়দ আবুল মকসুদ স্মৃতি সংসদ।
আবুল মকসুদের হঠাৎ চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভাসানীর ওপর আবুল মকসুদ পাঁচটি বই লিখেছেন। ভাসানীকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এসব বই কত মূল্যবান—যখন পড়ব, তখন বুঝতে পারব। এসব বই ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশে ইতিহাসের চর্চা খুব ক্ষীণ পর্যায়ে চলে এসেছে। সেখানে এই ধরনের বই কত মূল্যবান, সেটা সবাই আমরা বুঝতে পারি।’
ভাসানীর ওপর আবুল মকসুদ পাঁচটি বই লিখেছেন। ভাসানীকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এসব বই কত মূল্যবান—যখন পড়ব, তখন বুঝতে পারবইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে চাইলে ‘ভাসানীচরিত’ বইটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলেও মনে করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, এই বইয়ে মাওলানার যে পরিচয় ফুটে উঠেছে এবং যে পরিচয় ফুটে ওঠা দরকার, সেটা হলো তিনি ধর্মে মুসলমান ও জাতিতে বাঙালি। এ কথা তিনি লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনে ১৯৫৪ সালে বলেছেন। তিনি পীর ছিলেন। তাঁর ভক্ত, মুরিদরা তাঁকে অর্থ দিতেন। তিনি যে সম্মেলন–সমাবেশ করতেন, সেখানে ভুক্ত–মুরিদদের কাছ থেকে অর্থ আসত। তিনি বড়লোকের কাছ থেকে অর্থ নিতেন না। যাঁরা অত্যন্ত অসুস্থ, তাঁদের সেখান থেকে অর্থ দিতেন, বলতেন, ‘এটা দিয়ে তুমি ওষুধ কিনে খেয়ো।’ তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। মানুষ তাঁর কাছে এসে সাহায্য চাইলে তাঁদের নিরাশ করতেন না, সেটাকে তিনি নিষ্ঠুরতা মনে করতেন।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, মাওলানা ভাসানী মেহনতি মানুষের মুক্তি ও সামাজিক বিপ্লবের জন্য ধারাবাহিকভাবে সারা জীবন রাজনীতি করেছেন। মাওলানার পরিচয় ওইটাই যে তিনি সমাজবিপ্লবী ছিলেন। সে জন্যই কেবল রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, সামাজিক সংগ্রামকেও গুরুত্ব দিতেন।
মাওলানা ভাসানী নির্বাচনে আস্থা রাখেননি মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘১৯৪৬ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দেখেছেন, কাজ হলো না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন দেখেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি অংশই নিলেন না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরিণতি হলো গণহত্যা। নির্বাচনে কাজ হবে না, অভ্যুত্থান দরকার। আন্দোলন ও এর মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান। ভাসানীর এই পরিচয়গুলো এই বইয়ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এটিই একমাত্র বই হবে, তা নয়। আমরা আরও বই পাব। মাওলানাকে বুঝতে হলে সৈয়দ আবুল মকসুদের বই আমাদের প্রয়োজন হবে।’
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, কয়েক দশকের রাজনীতি ও তার উত্তান–পতন, পাকিস্তান রাষ্ট্র, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলন এবং গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা। এসব আন্দোলনে বিভিন্ন মানুষের যে অবদান, মাওলানা ভাসানীর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের যে অবদান, সেটাকে অস্বীকার করার প্রবণতা বড় ধরনের বিকৃতি, আঘাত বা রাজনৈতিক পরাজয়। মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালনের পরও তাজউদ্দীন আহমদের নামই আসে না। ইতিহাসের বাস্তব চরিত্রগুলোকে এভাবে অপমান করা দেশের অগ্রগতির পথে বড় বাধা। সৈয়দ আবুল মকসুদ বেঁচে থাকলে আরও কাজ করতেন। বেঁচে থাকতে তিনি যতটুকুই কাজ করেছেন, এগুলো ইতিহাসকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
জীবদ্দশায় সৈয়দ আবুল মকসুদকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি এবং এখনো হচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভাসানীকে নিয়ে আবুল মকসুদের লেখা বই যাঁরা চিন্তা ও গবেষণা করছেন, তাঁদের অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত।
‘ভাসানীচরিত’ বইয়ে মাওলানা ভাসানীর স্তুতি করেননি সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি ভাসানীকে বোঝার চেষ্টা করেছেন বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। বই পড়ার পর কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা ছিল, যা বইয়ে চোখে পড়েনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান ও সৈয়দ আবুল মকসুদের ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি ইমরান মাহফুজ।