তিন দশক আগেও ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। কমতে কমতে এখন জলাভূমির পরিমাণ ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। অর্থাৎ তিন দশকে ঢাকায় জলাভূমি কমেছে ১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে কোনো শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে সেই শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত রাখতে হয়। ঢাকা শহরে এখন সেটি আছে মাত্র ৯ শতাংশ।
এসব তথ্য উঠে এসেছে নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায়। শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে বিআইপি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা সংলাপে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
নগর-পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। কিন্তু বিআইপির গবেষণার দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এখন সেটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন তা মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত তিন দশকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে।
বিআইপি গবেষণাটি করেছে গত বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে। এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে (১৯৯৫ সালের পর থেকে) ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিআইপির গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণহীন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকায় তাপপ্রবাহের প্রভাব অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। এর পেছনে ব্যক্তি, বেসরকারি গোষ্ঠী ও সরকারি সংস্থা সবার দায় রয়েছে। ‘উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে’ বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন না থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
ঢাকার তাপপ্রবাহের পেছনে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে বিআইপি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নগর-পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা ও জলাশয় রক্ষায় ব্যর্থতা; কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি; সরকারি সংস্থাগুলোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে গাফিলতি; দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলা; নগর সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড; ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত থাকা; কাচ নির্মিত ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসিনির্ভর) ভবনের নকশা তৈরি এবং প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের এলাকার মানুষের বাসস্থানে বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা অনেক কম থাকা।
ঢাকায় তাপদাহের মাত্রা কমাতে বিআইপির পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিদ্যমান সবুজ ও জলাশয় এলাকা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়া, দখল হওয়া খাল ও সবুজ এলাকা পুনরুদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ, নগর এলাকায় সবুজায়ন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আবাসিক এলাকা ও ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে সবুজায়ন ও বনায়নের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন, সরু সড়কের পাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ বন্ধ করা এবং নগর-পরিকল্পনা ও ভবনের সঠিক নির্মাণ নিশ্চিতে পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও প্রকৌশলীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা অন্যতম।
গতকালের পরিকল্পনা সংলাপে ‘ঢাকায় তাপদাহ: নগর–পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, গত দুই দশকে ঢাকায় ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে হয় ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
পরে আলোচনায় অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যাচ্ছে। সরকারি সংস্থা উন্নয়নের নামে জলাশয় ভরাট ও মাঠ দখল করেছে। সরকারি সংস্থাগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রমে জবাবদিহি নেই। সরকারি সংস্থাগুলো নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের কথা শোনে না। পরিস্থিতি এমন যে অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার দুই মেয়রকেও অসহায় মনে হয়।
বর্তমান বাস্তবতায় ঢাকাকে আদর্শ বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করার সম্ভাবনা দেখেন না বিআইপির সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ঢাকাকে হয়তো জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে চলার মতো করা সম্ভব। তবে বর্ধিত ঢাকা (দুই সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন এলাকা) এবং পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প যেন পরিকল্পিত হয়, সেই চেষ্টা থাকা দরকার। তবে কাজটি করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ঢাকার তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বৃদ্ধির জন্য শুধু বৈশ্বিক কারণ দায়ী নয়, নিজেদের দায়ই বেশি বলে মনে করেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান। তিনি পরিকল্পনা সংলাপে বলেন, উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বোঝায় না, বরং দেশের সব মানুষ যেন সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারে, সেই দেশ গঠন করাই প্রকৃত উন্নয়ন।
বিআইপির বোর্ড সদস্য আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ঢাকার অনেক খালের ক্ষেত্রে দেখা যায় মানচিত্র ও দলিলে তা ২৫-২৬ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে ১০-১১ কিলোমিটারও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাকি খাল কে গিলে ফেলল? এই দখল ঠেকানোর দায়িত্ব যাদের, তারা কী করে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।