মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত নতুন প্রজন্মের নাগরিক গড়ে তুলতে যে নিরলস পরিশ্রম করেছেন সারা জীবন, সেই নবীনেরা গার্ড অব অনার দিয়ে চিরবিদায় জানিয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠক পান্না কায়সারকে। আজ রোববার শহীদজায়া, লেখক, শিশুসংগঠক অধ্যাপক পান্না কায়সারকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে তাঁর কফিন।
খেলাঘরের শিশু-কিশোর এবং বর্তমান ও সাবেক সংগঠকেরা সংগঠনের পতাকা দিয়ে কফিনটি আচ্ছাদিত করে দেন। পরিয়ে দেন দলের লাল স্কার্ফ। দলীয় সংগীত ‘আমরা তো সৈনিক, আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য/ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা, আমরা তো জীবনে তূর্য’ গেয়ে জানান অন্তিম বিদায়।
পান্না কায়সার প্রায় মাসখানেক থেকে মেয়ে বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী শমী কায়সারের গুলশানের বাসায় ছিলেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তাঁর ঘুম না হওয়ায় শুক্রবার সকাল ছয়টার দিকে বিস্কুট ও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যেই ইন্তেকাল করেন। সকাল ১০টার দিকে ঘুম থেকে না জাগায় তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন বাদ জুমা গুলশানের আজাদ মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা এবং নিউ ইস্কাটনের গাউস নগরের বাসভবনের প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজর পর বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে মরদেহ রাখা হয়েছিল।
আজ রোববার পূর্বনির্ধারিত সময় অনুসারে বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পান্না কায়সারের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জেটের ব্যবস্থাপনায় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়েছিল ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা খেলাঘরের কর্মী ও সংগঠকদের দেওয়া গার্ড অব অনারের মধ্য দিয়ে। এরপর মন্ত্রী, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকাশকদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাংসদ রাশেদ খান মেনন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান, সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে অসীম কুমার উকিল, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, দৈনিক সংবাদের পক্ষে নিহাদ কবির, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি ওসমান গনি, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজির লিটন, চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌসসহ অনেকে।
সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতিসংঘ সমিতি, খেলাঘরের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলা কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, গ্রাম থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, রক্তধারা ৭১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নীল দল, এফবিসিসিআই, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, শিশু একাডেমি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, ৭১ ফাউন্ডেশন, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ছিল উল্লেখযোগ্য। জোটের পক্ষে মানজার চৌধুরী এই পর্ব সঞ্চালনা করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পান্না কায়সারের সংগ্রামী জীবন ও অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও স্মৃতিচারণা করেন। তাঁরা বলেন, অধ্যাপক পান্না কায়সার তাঁর স্বামী বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে হারিয়ে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কঠিন জীবনসংগ্রাম করেছেন। একদিকে সন্তানদের বড় করা, পেশাগত দায়িত্ব পালন, অন্যদিকে খেলাঘরের মতো দেশের অন্যতম প্রধান একটি শিশু সংগঠন পরিচালনা করার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। তিনি আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদার গণতান্ত্রিক ভাবনা, অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ধারণ করেছেন। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রয়াণে এ ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়।
পরিবারে পক্ষে তাঁর মেয়ে শমী কায়সার ও ছেলে অমিতাভ কায়সার তাঁদের মায়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হয়। বাদ জোহর এখানে তৃতীয় জানাজার পর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ আনা হয় বাংলা একাডেমিতে। একাডেমির বটতলার নজরুল মঞ্চের সামনে একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা একাডেমির কর্মকর্তা কর্মচারী ও সাহিত্যিকদের নিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক পান্না কায়সারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
একাডেমি থেকে মরদেহ আনা হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এখানেই তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।