‘জৈমতের চালা’ নামে পতিত জমিটুকুতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে খেলত, আড্ডা দিত। একদিন হঠাৎ সেই জমির মালিকানা বদল হয়। হারিয়ে যায় জৈমতের চালা। গ্রামের স্কুলপড়ুয়া কিশোর তবারক হোসাইন তা মেনে নিতে পারেননি। কৈশোরেই সংকল্প করেন শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিনোদনে সমৃদ্ধ একটি গ্রাম গড়ে তোলার।
১৯৮১ সালে নবম শ্রেণিপড়ুয়া তবারক নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন আরও চার বন্ধুর মাঝে। মাত্র ৬০ টাকা পুঁজি নিয়ে পাঁচ কিশোর নিজেদের স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করেন। গড়ে তোলেন অগ্রপথিক পল্লী সমিতি। সেই সমিতির গড়ে তোলা ‘ঐকতান’ আজ গ্রামের শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বিনোদনের চাহিদা মেটাচ্ছে। সারা দেশের মানুষের কাছে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। লোকমুখে যার নাম হয়ে গেছে ‘জিন্দা পার্ক’।
নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন সেতু থেকে উত্তরে এগোলে ঢাকা বাইপাস সড়ক। সড়কের দুই পাশে পূর্বাচল নতুন শহর। সড়ক ধরে উত্তরে কিছু দূর যেতেই কানে আসে চেনা-অচেনা সব পাখির কলতান। ধূসর নগর ছেড়ে নৈসর্গিক গ্রামে ঢুকতেই পাখিরা যেন সমস্বরে আহ্বান জানাচ্ছে।
পার্কে যেতে সড়কের দুপাশে সারি সারি দেশি–বিদেশি গাছ। তার মাঝে কালো পিচের সড়ক। ছায়াঘেরা সড়কে পা রাখতেই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
গেল বুধবার সবুজে মোড়ানো সড়ক ধরে পার্কে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, আলপনা আঁকতে ব্যস্ত এক দল চিত্রশিল্পী। গাছের পাতার ফাঁক গলে বসন্তের নরম রোদ এসে পড়েছে সেই আলপনায়। সড়কের পাশের বকুল ছায়ায় বসে শিল্পীদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন তবারক হোসাইন। জানালেন, প্রতি বৈশাখে তাঁরা বাউল উৎসব করেন। তারই প্রস্তুতি চলছে। সড়কের পাশেই দেখা গেল, সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে অনন্য স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন ভবন।
কথা হলো পার্কের পরিচালক আবদুল্লাহ আল শাহীনের সঙ্গে। জানালেন ভবনটি অগ্রপথিক পল্লী সমিতির গড়ে তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ে।
পাঁচ কিশোর মিলে শুরু করা অগ্রপথিক পল্লী সমিতির সদস্য সংখ্যা এখন পাঁচ হাজারের বেশি। সেই সদস্যদের প্রায় চার দশকের নিবিড় চেষ্টায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জিন্দা গ্রামে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের এই কমিউনিটি ভিলেজ। এটিকে তাঁরা প্রথাগত কোনো ‘পার্ক’ কিংবা ‘রিসোর্ট’ বলতে নারাজ, বললেন আবদুল্লাহ আল শাহীন। তাঁর ভাষ্য, এই কমপ্লেক্স প্রাণ-প্রতিবেশের বৈচিত্র্যময় সম্পর্ককে ধারণ করা সমাজব্যবস্থার নিদর্শন। তাঁদের স্লোগান, ‘দরদি সমাজ গঠন।’
কমপ্লেক্সটিকে তাঁরা ডাকেন ‘ঐকতান’ নামে। তাঁরা শান্তিনিকেতনের আদলে গড়তে চান এটিকে। তখন নাম হবে ‘শান্তিকানন’। অবশ্য এখন এটি ‘জিন্দা পার্ক’ নামে পরিচিত।
মাঠের পশ্চিমে দেখা গেল, ঘন গাছপালায় ঘেরা জঙ্গল। জঙ্গলে প্রবেশে সরু সড়কের তোরণে লেখা রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ পাশের লেকের ধারে সাত বছরের শিশু তানভীর হাসানকে নিয়ে খেলছিলেন ঢাকার মতিঝিল থেকে আসা ব্যবসায়ী আহমদ হাসান ও তাঁর স্ত্রী নয়না আক্তার। জানালেন, চাকরির প্রয়োজনে ঢাকায় থাকেন। সুযোগ পেলেই বিক্রমপুরে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। আর গ্রামে যেতে না পারলে আসেন জিন্দা পার্কে। আহমদ হাসান বলেন, ‘পার্ক বলতে আমরা যা বুঝি, এটা তার চেয়েও বেশি কিছু। এখানে মাটির স্পর্শ পাওয়া যায়।’
তিন দিক থেকে জলাশয়ঘেরা জিন্দা পার্ক ঘুরে মোট পাঁচটি জলাশয় দেখা গেল। এ ছাড়া দেখা গেল পদ্মপুকুর, পুকুরের মাঝে নির্মাণ করা সাঁকো, কৃত্রিম দ্বীপ, ব্যতিক্রমী স্থাপনার গোলাকার পাঠাগার, মাটির ঘরবাড়ি, মসজিদ, ক্যানটিন, গাছের মগডালে তৈরি ট্রি–হাউস, খোলা মাঠ আর চেনা–অচেনা হাজারো গাছ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, জিন্দা পার্কে আড়াই শ প্রজাতির ২৫ হাজারের বেশি গাছগাছালি আছে। এগুলোকে ঘিরে বেঁচে আছে হাজারো পাখপাখালি, পোকামাকড়, সরীসৃপসহ নানা প্রাণী। এর মাধ্যমে তাঁরা সর্বপ্রাণের সহাবস্থানের নিদর্শন তৈরি করতে চেয়েছেন।