আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকার ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে ১০ তলা বিপণিবিতান নির্মাণ করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবিত এই বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ ২০২৮ সালে শেষ হতে পারে। নির্মাণকাজ শেষে নতুন বিপণিবিতানে উঠতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকেরা। ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, ভূমিতলসহ (বেজমেন্ট) ১০ তলা এই বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে শুরু হতে পারে। বিপণিবিতানের নির্মাণব্যয়ের পুরো টাকা দোকানমালিকদের কাছ থেকে নেওয়া হবে।
গত বছরের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ৫০টি ইউনিটের সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোটাই পুড়ে যায়।
ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। আগুনে ৩০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। এ ব্যাপারে তারা ১০ বার নোটিশও দেয়। অন্যদিকে ডিএসসিসি বলছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে তারা আগেই নতুন বহুতল ভবন করতে চেয়েছিল। কিন্তু দোকানমালিকদের বাধায় তা হয়নি। গত বছরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে ১০ তলা বিপণিবিতান নির্মাণের নতুন পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি।
আরও পড়ুন:
দোকানমালিকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হবে
ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত সিটি করপোরেশন যেসব বিপণিবিতান নির্মাণ করে, তার খরচের অর্থ দোকান পেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এটা সিটি করপোরেশনের আয়ের অন্যতম খাতও। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে থাকা দোকানগুলোও টাকার বিনিময়ে বরাদ্দ দিয়েছিল ডিএসসিসি। এখন সেখানে প্রস্তাবিত ১০ তলা বিপণিবিতান নির্মাণের ৩৬৫ কোটি টাকা দোকানমালিকদের কাছ থেকে চার কিস্তিতে নেওয়া হবে। কিছুদিনের মধ্যেই এই টাকা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর (অ্যাকাউন্ট) খোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটের মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ও বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাজমুল হুদার নামে খোলা এই হিসাবে ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আসা এই সহায়তার অর্থ কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এখনো হাতে পাননি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন গতকাল সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে টাকা বিতরণ করা যায়নি। টাকাগুলো ব্যাংকেই আছে। মুনাফা বাড়ছে। এ বিষয়ে তাঁরা ডিএসসিসির মেয়রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
তবে ডিএসসিসির একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, যে টাকা জমা হয়েছে, তা প্রস্তাবিত বিপণিবিতান নির্মাণে খরচ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নতুন বিপণিবিতানে দোকানপ্রতি ব্যবসায়ীদের যে পরিমাণ অর্থ দিতে হবে, তার সঙ্গে সহায়তার টাকা সমন্বয় করা হবে।
বিপণিবিতান নির্মাণে লাগবে ৪ বছর
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, বঙ্গবাজারে ১০৬ কাঠা জমির ওপর নতুন বিপণিবিতানটি নির্মাণ করতে অন্তত ৪ বছর সময় লাগবে। বিপণিবিতান নির্মাণে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত।
বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, মহানগর হকার্স মার্কেট ও আদর্শ হকার্স মার্কেট—এই চার মার্কেট নিয়ে গঠিত হবে নতুন বিপণিবিতান। এর নাম ঠিক করা হয়েছে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণিবিতান’।
ডিএসসিসির হিসাবে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেটে ২ হাজার ৯৬১টি বৈধ দোকান ছিল। এসব দোকানমালিকেরা বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনের তহবিলে দুই লাখ টাকা করে জমা দিয়ে বরাদ্দ পেয়েছিলেন। বৈধ বরাদ্দপত্র ও প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে এই মালিকদের সবাই নতুন বিপণিবিতানে দোকান পাবেন বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির কর্মকর্তারা।
নতুন বিপণিবিতানে দোকানসংখ্যা হবে ৩ হাজার ২১৫টি। অর্থাৎ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের তুলনায় নতুন বিপণিবিতানে অতিরিক্ত ২৪৬টি দোকান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, পুড়ে যাওয়া মার্কেটে দোকানের আকার ছিল সর্বনিম্ন ১৭ বর্গফুট, সর্বোচ্চ ২২ বর্গফুট। নতুন বিপণিবিতানে দোকানের আকার হবে ৮০ থেকে ১২০ বর্গফুট। দোকানের আকার বড় হওয়ার কারণে আগের মালিকদের দোকানপ্রতি গড়ে ২০ লাখ টাকার মতো সিটি করপোরেশনের তহবিলে জমা দিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের এক দোকানমালিক আবদুল গনি গাজী প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিপণিবিতান নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে তাঁরা শুনছেন। সেখানে দোকান বুঝে পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলে ২০ লাখ টাকা করে দিতে কেউ আপত্তি করবেন না বলেই তাঁর মনে হয়।
বঙ্গবাজারে এখন যেভাবে ব্যবসা চলছে
অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে খোলা আকাশের নিচে চৌকি বসিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন দোকানিরা। দীর্ঘদিন এভাবে চলা পর ত্রিপল টাঙিয়ে অস্থায়ী দোকান বানিয়ে সেখানে এখন ব্যবসা চলছে।
গতকাল বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিটি অস্থায়ী দোকানে বৈদ্যুতিক সংযোগ আছে। খোপ খোপ করে বানানো ছোট দোকানগুলোয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বেচাবিক্রি করছেন দোকানিরা। তবে এ সময় ক্রেতাদের খুব একটা আনাগোনা চোখে পড়েনি।
অবশ্য আরিফ ব্যাপারী নামের এক দোকানি বললেন, খোলা আকাশের নিচে চৌকি বসিয়ে দোকান চালুর পর খুব একটা বেচাবিক্রি হতো না। তবে আগের চেয়ে এখন ব্যবসা ভালো।
এখানে নতুন বিপণিবিতান নির্মাণের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে, এ তথ্য জানেন কি না—এমন প্রশ্নে আরিফ বলেন, দোকান মালিক সমিতি থেকে তাঁদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় অন্য কোথাও গিয়ে ব্যবসা করার কথা ভাবছেন তিনি।
বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির তিন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে যাঁরা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছেন, তাঁদের কাউকে ভাড়া দিতে হচ্ছে না। মানবিক দিক বিবেচনায় তাঁরা (দোকানমালিক) কোনো ভাড়া নিচ্ছেন না। তবে সব দোকানিকে পবিত্র রোজার ঈদের পর অস্থায়ী দোকান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরই সেখানে নতুন বিপণিবিতান নির্মাণের কাজ শুরু হবে।