ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটিকে অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাকসিম এ খান ওয়াসাকে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ‘স্বৈরাচারী’ কায়দায় পরিচালনা করেন। তাকসিম ওয়াসা বোর্ডকে দীর্ঘ দিন ধরে অবমাননা করলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া লিখিত অভিযোগে এসব কথা বলেছেন। তাতে বিষয় হিসেবে লেখা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সঙ্গে অসহযোগিতা, অসদাচরণ এবং পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন ১৯৯৬–এর বিধি অমান্যকরণ প্রসঙ্গে।
মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা ওয়াসার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে ব্যক্তিই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁকেই তিনি চাকরি থেকে অপসারণ করেন। এমডি ঢাকা ওয়াসার বাজেটে কোটি কোটি টাকা বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছামতো বাজেট–বহির্ভূত খরচ করেন। এমডি তাকসিম ক্ষমতার দাপট দেখাতে নিজের সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করে রেখেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের সঙ্গে ওয়াসা বোর্ডের দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াসা প্রশাসনের কিছু বিষয়ে বোর্ড হস্তক্ষেপ করে। বোর্ড চেয়ারম্যানের এসব উদ্যোগের কারণে এমডি তাকসিম ক্ষুব্ধ। তিনি বোর্ড চেয়ারম্যানকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। বোর্ড চেয়ারম্যানকে চাপে রাখতে তাঁর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমডির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানালেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। ঢাকা ওয়াসার ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমডি তাকসিম এ খান ওয়াসা বোর্ডের নির্দেশ মানেন না। আমি যে অভিযোগ করেছি, সেগুলো নিয়ে মন্ত্রণালয় বোর্ডের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করতে পারে। এই অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
ওয়াসার আইন অনুযায়ী, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বোর্ডসভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওয়াসার ৩০২তম বোর্ড সভা হয়েছিল গত ১৫ মার্চ। গত ১৬ এপ্রিল চেয়ারম্যান ৩০৩তম বোর্ডসভা আহ্বান করেন। কিন্তু ওই দিন এমডির অনুরোধে বোর্ডসভা স্থগিত করা হয়। এরপর এমডি জার্মানিতে যান।
মন্ত্রণালয়ে দেওয়া লিখিত অভিযোগে ওয়াসা চেয়ারম্যান বলেন, দেশে ফেরার পর তাকসিম আর বোর্ড সভার কথা বলেননি। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে ১৫ মের আগেই ৩০৩তম সভা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। চেয়ারম্যান ১৭ মে বোর্ডসভা আহ্বান করেন। এমডি তাকসিম ও ওয়াসার সচিবকে সভা আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু ওয়াসার এমডি বা সচিব সভা আয়োজনের কোনো ব্যবস্থা করেননি। তাঁরা দুজনই বোর্ডকে অবমাননা করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা দুজনেই ওয়াসা আইন লঙ্ঘন করেছেন।
বোর্ডের ৩০৩তম সভার আলোচ্যসূচি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকায় তাকসিম এ খান বোর্ড সভা আয়োজন করেননি বলে ওয়াসা চেয়ারম্যান অভিযোগে করেছেন। সভার ৭ নম্বর আলোচ্যসূচি ছিল, নিয়ম ভেঙে ওয়াসা এমডির অডিট ফার্ম নিয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াসা প্রশাসনের ব্যাখ্যা উপস্থাপন। ৮ নম্বর আলোচ্যসূচি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলমগীর হাছিন আহমেদকে হাজিরা ছাড়া নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যাখ্যা উপস্থাপন। ১০ নম্বর আলোচ্যসূচি ছিল, ওয়াসার পানির এটিএম বুথের বিষয়ে মার্কিন কোম্পানি ড্রিংকওয়েলের সঙ্গে চুক্তিসহ বিশদ বিবরণ বোর্ডে উপস্থাপন। আলোচ্যসূচিতে এই বিষয়গুলো থাকায় ওয়াসা এমডি বোর্ডসভা আয়োজন করতে চাচ্ছেন না বলে অভিযোগ বোর্ড চেয়ারম্যানের।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিমের মুঠোফোনে সন্ধ্যায় কল করলেও তিনি ধরেননি।
ওয়াসার চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা তার অভিযোগে বলেন, ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান নিজের ক্ষমতার দাপট দেখাতে এবং বোর্ডকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করেছেন। তাঁর কোনো জবাবদিহি নেই। আইনে পরিষ্কার উল্লেখ থাকলেও বিদেশে ছুটিতে অবস্থানকালীন সময়ে তাকসিম বোর্ড সভা করতে বাধা দিয়েছেন।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের নিজস্ব কোনো সচিবালয় নেই। কোনো কর্মকর্তাও নেই। বোর্ড সচিব নামে কোনো পদও অর্গানোগ্রামে নেই। ঢাকা ওয়াসার সচিব পদে আগে সরকার থেকে প্রেষণে কর্মকর্তা আসতেন। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিতে একজন প্রকৌশলীকে ওয়াসার সচিব পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে রাখা হয়েছে।
চেয়ারম্যান তার অভিযোগে বলেছেন, এমডি তাকসিম ওয়াসার সচিবকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। ঢাকা ওয়াসার সচিব বোর্ড চেয়ারম্যান বা বোর্ড সদস্য কারও কাজ করেন না। তাকে ডেকেও পাওয়া যায় না। এমডি অফিসে না থাকলে তিনিও থাকেন না। প্রেষণে ওয়াসার সচিব আনার পদ্ধতিটি আবার চালু করা জরুরি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা ওয়াসার সচিব শারমিন হক আমীরের মুঠোফোনে সন্ধ্যায় কল করা হয়; কিন্তু তিনি কল ধরেননি।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে অংশ নেন ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। সেখানে তিনি সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তোলেন। টক শোতে চেয়ারম্যান বলেন, ওয়াসা বোর্ড কার্যত অকার্যকর। তাকসিম তাঁর অনুপস্থিতিতে বোর্ডের সভা হতে দেন না।
বোর্ড চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ১১ মে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি সংগঠনের নামে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ঢাকা ওয়াসা সূত্র বলছে, চিঠিতে যাঁরা সই করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ তাকসিমের ‘সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত। কেউ আবার চাপে পড়ে চিঠিতে সই করেছেন।
ওয়াসা চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে বলেন, ‘ওয়াসার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে টেলিভিশনে খোলামেলা বক্তব্য রেখেছি। সেখানে যা বলেছি সব সত্য বলেছি। ঢাকা ওয়াসাকে বাঁচাতে এসব কথা বলার প্রয়োজন আছে। এমডি ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, জোরপূর্বক চেয়ারম্যানের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দেওয়াতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। সবশেষে মেয়াদোত্তীর্ণ অবৈধ বিভিন্ন সমিতিকে দিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইবরাহিম এবং পানি সরবরাহ শাখার অতিরিক্ত সচিব খাইরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কেউই সাড়া দেননি।
ঢাকা ওয়াসার সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে বোর্ড চারটি কমিটি করেছে। কমিটিগুলো হচ্ছে—ঢাকা ওয়াসার পূর্ণাঙ্গ বাজেট তৈরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ওয়াসা আইন অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে বিনিয়োগ বা ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ, ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির অর্থ লুটপাটের তথ্য অনুসন্ধান এবং ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের অডিট কমিটি।
চেয়ারম্যানের অভিযোগে বলা হয়েছে, তাকসিম এ খান এই কমিটিগুলোর কাজে অসহযোগিতা ও বাধা সৃষ্টি করছেন এবং কমিটিগুলোকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। এই কমিটিগুলো কাজ করতে পারলে ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হতো।
ওয়াসার চেয়ারম্যান আরও বেশ কিছু অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ওয়াসায় আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। যে সংখ্যক আউটসোর্স কর্মীকে বেতন দেওয়া দেখানো হয়, বাস্তবে লোকবল আছে তার চেয়ে কম। বারবার বলার পরেও আউটসোর্স জনবল নিয়োগের বিষয়টি বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হয় না।
প্রয়োজন না থাকলেও এমডি তাকসিম খান পানির দাম বাড়াতে আগ্রহী। অনিয়ম, অপচয় আর লুটপাট কমিয়ে আনলে পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। ওয়াসা পানির উৎপাদনের যে খরচ দেখায়, সেটাও ভুল। তাকসিম এ খান এসব বিষয়ে বোর্ডে আলোচনা করতেও আগ্রহী নন।
গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এটি ঠেকাতে ১৫ বছর আগে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশি ঋণ নিয়ে পানি শোধনাগার নির্মাণ শুরু করেছে। অথচ এখনো ওয়াসার সরবরাহ করা পানির প্রায় ৭৫ ভাগই ভূগর্ভস্থ উৎসের। এ সময়ে গভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ওয়াসায় প্রকল্প শুরু হলে শেষ হতে চায় না। প্রকল্পের খরচ আকাশচুম্বী হয়ে যায়। ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় নির্মিত পদ্মা পানি শোধনাগার তিন বছর ধরে অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে।
চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা তার অভিযোগে বলেন, ঢাকা ওয়াসার বাজেটে তাকসিম কোটি টাকার বিভিন্ন বিষয় লুকিয়ে রাখেন এবং বাজেট–বহির্ভূত খরচ করেন। বোর্ড কোনো বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। চাকরি হারানোর ভয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ মুখ খোলেন না। একটি সরকারি সংস্থা এভাবে চলতে পারে না। এত সমস্যা থাকলেও ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের যেন কিছুই করণীয় নেই।