ঢাকার দ্রুতগতির উড়ালসড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) দিয়ে বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে। তবে অনুমতি থাকা সত্ত্বেও এই উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচলের ব্যাপারে বাস-মিনিবাসের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু কেন দ্রুতগতির উড়ালসড়কে বাস-মিনিবাস উঠছে না? সংশ্লিষ্ট বাস-মিনিবাস কোম্পানির মালিকেরা বলছেন, এই উড়ালসড়ক দিয়ে চললে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাবে না। মূলত, এ কারণেই দ্রুতগতির উড়ালসড়কে বাস-মিনিবাস উঠছে না।
তবে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি এই উড়ালসড়ক দিয়ে কিছু বাস চালু করা যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু সংস্থাটিরই সূত্র বলছে, দ্রুতগতির উড়ালসড়কে বাস চালু করা লাভজনক হবে না।
যানজট এড়িয়ে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণমুখী যানবাহনের যাতায়াত নিশ্চিতে এই উড়ালসড়কের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ দিন কয়েক আগে চালু হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর এই অংশে চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ছয়টা থেকে সাধারণ যানবাহনের চলাচল শুরু হয়। তেজগাঁও থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত উড়ালসড়কের বাকি অংশ আগামী বছরের জুনে চালু করার লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার।
দ্রুতগতির এই উড়ালসড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত চালু হওয়া অংশের দূরত্ব সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৫টি স্থানে ওঠানামা করার ব্যবস্থা (র্যাম্প) আছে। বিমানবন্দর এলাকায় দুটি, কুড়িলে তিনটি, বনানীতে চারটি, মহাখালীতে তিনটি, বিজয় সরণিতে দুটি ও ফার্মগেট এলাকায় একটি ওঠানামার জায়গা আছে। তবে মহাখালী ও বনানী ১১ নম্বর দিয়ে নামার পথ দুটি পরে চালু হবে।
উড়ালসড়ক দিয়ে আট ধরনের যানবাহন চলাচলের অনুমতি রয়েছে। এগুলো মধ্যে রয়েছে বাস, মিনিবাস, কার (সেডান), মাইক্রোবাস, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি, যা জিপ নামে পরিচিত), কয়েক ধরনের পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপ। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যান ও বাইসাইকেল চলাচলের অনুমতি নেই। পথচারীদেরও চলাচলের অনুমতি নেই। এই চিত্র থেকে অনেকেই বলছেন, উড়ালসড়কটি আসলে ‘ধনীদের’ জন্য। ফলে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প ঢাকার সাধারণ মানুষের তেমন কাজে আসবে না।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চালুর প্রথম তিন দিনে উড়ালসড়কটি দিয়ে ৪৮ হাজার ৭৩৯টি যানবাহন চলাচল করেছে। এতে আয় হয়েছে ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রতি যানবাহন থেকে আয় হয়েছে গড়ে ৮২ টাকা।
কোন কোন যানবাহন কতটি চলেছে, তা এখনো আলাদা করেনি সেতু কর্তৃপক্ষ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম তিন দিনে বাস বা ট্রাক চলেনি। কারণ, কার, ট্যাক্সি, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ আসনের কম) ও হালকা ট্রাক (৩ টনের কম)—এই শ্রেণির যানবাহনের টোল ৮০ টাকা। মাঝারি ট্রাকের (৬ চাকা পর্যন্ত) টোল ৩২০ টাকা। ৬ চাকার বেশি ট্রাকের টোল ৪০০ টাকা। সব ধরনের বাসের টোল ১৬০ টাকা।
প্রথম তিন দিনে গড়ে প্রতি যানবাহন থেকে যেহেতু ৮২ টাকা আয় হয়েছে, সেই বিবেচনায় অন্য যানবাহন তেমন চলেনি বলেই ধারণা করা হয়। সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কয় দিনে হাতে গোনা কয়েকটি বাস চলাচল করে থাকতে পারে।
এখন মহাখালী বাসটার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কিছু বাস এই উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচলের সুযোগ রয়েছে। তবে মহাখালী বাসটার্মিনালের সামনে উড়ালসড়ক থেকে নামার পথ চালু হলেও ওঠার পথ এখনো চালু হয়নি। তাই ওঠার পথটি চালু হলে অল্প কিছু দূরপাল্লার বাস চলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকায় বাসের রুট আছে ৩০০টির কাছাকাছি। তবে কিছু রুটে বাস নামানো হয়নি। ঢাকায় সব মিলিয়ে বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমতি আছে প্রায় সাত হাজার। অন্যদিকে, উত্তরা-বিমানবন্দর সড়ক হয়ে বাসের রুট আছে ৩০টি। এই পথে প্রায় এক হাজার বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমতি আছে।
উড়ালসড়কটি দিয়ে পথচারীদের হাঁটাচলা নিষেধ। এ কারণে বাস-মিনিবাস উড়ালসড়ক দিয়ে চললে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাবে না। তাই উড়ালসড়কটিতে বাস-মিনিবাস উঠছে না বলে কয়েকজন মালিক জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বেই শহুরে মানুষের বড় অংশ স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করেন। ঢাকার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। ঢাকায় চালু হওয়া দ্রুতগতির এই উড়ালসড়কে টানা সাড়ে ১১ কিলোমিটারের মধ্যে বাস থেকে যাত্রীর নামার সুযোগ নেই। তাই মাঝপথে নামতে আগ্রহী যাত্রীদের বাসে উঠতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে টোল দিয়ে চলার বিষয়টি তো আছেই।
বিমানবন্দর সড়ক হয়ে চলাচল করে—এমন একটি বাস কোম্পানির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বাস গাজীপুর বা আশুলিয়ার ধউর থেকে বিমানবন্দর হয়ে জিল্লুর রহমান উড়ালসড়ক দিয়ে সেনানিবাসের ওপর দিয়ে মিরপুর চলে যায়।
এসব বাসের কাওলা থেকে এই উড়ালসড়কে উঠে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটারের জন্য ১৬০ টাকা টোল দেওয়ার কোনো মানে নেই। এ ছাড়া উড়ালসড়কটিতে উঠলে খিলক্ষেতসহ মাঝপথের যাত্রী তোলা যাবে না।
আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান বা গাজীপুর থেকে আজিমপুর পথে চলাচলকারী বাসগুলো চাইলে সাড়ে ১১ কিলোমিটারের এই উড়ালসড়কের পথের পুরোটা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাসমালিকেরা বলছেন, এই সাড়ে ১১ কিলোমিটারে বৈধভাবেই বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করার জন্য নিচে ৫ থেকে ৬টি স্টপেজ আছে। বাস উড়ালসড়ক দিয়ে চললে এসব স্টপেজের যাত্রীদের কী হবে? কেউ এসব স্টপেজে নামতে চাইলে তো তাঁরা তা পারবেন না।
মহাখালী টার্মিনালের সামনে উড়ালসড়কটি থেকে নামার একটা র্যাম্প আছে। একাধিক পরিবহনকর্মী জানিয়েছেন, দূরের জেলা থেকে আসা বাসগুলো থেকে আবদুল্লাহপুর-মহাখালী টার্মিনাল পর্যন্ত অংশে আট থেকে দশ স্থানে যাত্রীরা নামেন। বাসগুলো এই উড়ালসড়ক দিয়ে এলে যাত্রীরা আর নামতে পারবেন না।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ওঠার র্যাম্প চালু হলে কিছু বাস চলতে পারে। তবে অধিকাংশ দূরপাল্লার বাস জেলায় যাওয়ার সময় পথে পথে যাত্রী তোলে। তাই এই বাসগুলো উড়ালসড়কটিতে উঠতে চাইবে না। সব মিলিয়ে এই বাসগুলোর জন্য উড়ালসড়কটির কাজে আসার সম্ভাবনা কম।
ঢাকার উড়ালসড়কগুলোর মধ্যে শুধু মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ও ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কে টোল দিতে হয়। মেয়র হানিফ উড়ালসড়কটি অপেক্ষাকৃত ছোট, টোলও কম। তা ছাড়া এই উড়ালসড়কের নিচের পথ ভাঙাচোরা। এ জন্য কিছু বাস এই উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচল করে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, টোল, যাত্রীসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাসগুলো দ্রুতগতির উড়ালসড়কে উঠতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
পরিবহনমালিকেরা চাইলে বিআরটিএ থেকে অনুমোদন নিয়ে নতুন রুটে দ্রুতগতির উড়ালসড়ক ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে তাঁরা আবেদন করেনি বলে বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকার গণপরিবহন
ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে তিনটি বড় পরিকল্পনা হয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট স্টাডি (১৯৯৪), ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (২০০৫) ও ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক স্টাডি (২০১০)।
২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাটি (এসটিপি) ২০১৫ সালে হালনাগাদ করা হয়। জাপানের করা এই হালনাগাদ অনুসারে, ঢাকা ও তার আশপাশের মানুষ দিনে দুই কোটির বেশি বার যাতায়াত (ট্রিপ) করেন। এর মধ্যে দরকারি যাতায়াত বা কাজে যাওয়ার জন্য ৬০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করেন। আর গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের ৬৭ শতাংশ ব্যবহার করেন বাস-মিনিবাস। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বাস-মিনিবাস ঢাকার দ্রুতগতির উড়ালসড়ক ব্যবহার করতে চাইছে না।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় এসেছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিন্তু দ্রুতগতির উড়ালসড়কের সাড়ে ১১ কিলোমিটার যেতে সময় লাগছে ১২ থেকে ১৩ মিনিট।
২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অংশীজন সভার আয়োজন করেছিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
এ সভায় ‘ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বহু মাধ্যমভিত্তিক পরিবহনব্যবস্থার গুরুত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছিল। এতে বলা হয়, একটি শহরের মোট সড়কের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চললে তা যাত্রীর ১২ শতাংশ বহন করতে পারে। অন্যদিকে, ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বাস চললে ৮৮ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করা যায়।
দ্রুতগতির উড়ালসড়কের বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় সড়ক কম। তাই উড়ালসড়কে যে গাড়ি উঠছে, তা নিচের রাস্তার ওপর চাপ কমাচ্ছে। ফলে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন নিচের রাস্তা সহজে ব্যবহার করতে পারছে।
তবে গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, উড়ালসড়ক দ্রুত পাড়ি দিয়ে নামার স্থানে জট লেগে যাচ্ছে। এই জটের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে।