রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এখন রাস্তা পার হওয়াই দুষ্কর। যে পাতালপথ ছিল, মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরে বসানো পদচারী–সেতুটিও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা রাস্তা পারাপারে সহায়তা করেন। তবে কর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল। কাজেও ঢিলেমির অভিযোগ রয়েছে।
কারওয়ান বাজারে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ সড়কটি পার হওয়া নিয়ে বেশি ভোগান্তিতে থাকেন নারীরা। কারওয়ান বাজারের একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী মঞ্জিমা খাতুন বলছিলেন, কারওয়ান বাজারে রাস্তা পার হওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কখনো কখনো মেট্রোরেলের ঠিকাদারের কর্মী পাওয়া যায়, কখনো কখনো তাঁরা থাকেন না।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজ এখন চলছে। মেট্রোরেলের কাজ করার প্রয়োজনে কারওয়ান বাজারের পাতালপথটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এরপর পাশেই একটি পদচারী–সেতু নির্মাণ করা হয়। সেটি ছিল কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের সামনে। সেতুটি গত ১০ মে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে নির্মাণকাজের প্রয়োজনেই।
এখন পাতালপথ বা সড়কের ওপর দিয়ে পদচারী–সেতুর মাধ্যমে রাস্তা পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরুষেরা যানবাহন চলাচলের মধ্যেই দৌড়ে রাস্তা পার হন। কেউ কেউ সড়ক বিভাজকের বেড়া ডিঙিয়েও ঝুঁকি নিয়ে পার হন। নারী ও প্রবীণদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না।
পদচারী–সেতুর বদলে একটি জায়গায় রাস্তা পারাপারে সহায়তার জন্য কর্মী নিয়োগ করেছে মেট্রোরেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের সুপারভাইজার পলাশ রায় দাবি করেন, রাস্তার দুই পাশে (ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার) তিনজন করে মোট ছয়জন কর্মী দায়িত্ব পালন করেন। নির্দিষ্ট স্থানে মানুষ জড়ো হলে দুই পাশে দুজন লাল রঙের পতাকা তুলে ও যানবাহন থামিয়ে পার হওয়ার সুযোগ করে দেন। আরেকজন মাইকে পার হওয়ার কথা বলতে থাকেন। এভাবে দুই পালায় সারা দিন তাঁরা লোকজনকে রাস্তা পারাপার করে দেন। এসব দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন দুজন সুপারভাইজার।
অবশ্য পথচারীরা বলছেন, কর্মীসংখ্যা ও তৎপরতা বাড়ানো দরকার।
কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর একটি। এর কারওয়ান বাজার অংশের দুই পাশে বিপণিবিতান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় এবং কারওয়ান বাজারের মতো একটি বড় বাজার রয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষকে তাই সড়ক পার হতে হয়।
কারওয়ান বাজারের সিএ ভবন থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত পূর্ব পাশে মেট্রোরেলের অবকাঠামোর নির্মাণকাজের কারণে ফুটপাত সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। সড়কের দুই পাশে কোথাও কোথাও ফুটপাত পুরোটাই বন্ধ।
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের গলি থেকে বেরিয়ে কেউ কারওয়ান বাজারে যেতে চাইলে তাঁকে বাঁ দিকের কয়েকটি দোকানের সামনের সরু পথ দিয়ে গিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। এরপর পার হতে হয় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশ। এক পাশে আবার ‘সার্ভিস লেন’ রয়েছে। এর ফলে পার হতে হয় মূলত তিনটি রাস্তা।
ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। জানতে চাইলে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, পদচারী–সেতু কিংবা পাতালপথ—কোথায় কী লাগে, সেটা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বসে ঠিক করা হয়। বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এই মন্তব্যের কয়েক দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খান বলেন, মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে সড়কের এই অংশ ডিএমটিসিএলকে দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ শেষে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ রাস্তাটি সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেবে। এ সময় সড়কের নিরপত্তার দায়িত্বটিও তাদেরই।
এরপর ১৩ জুন আবার ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি নিজে কারওয়ান বাজার এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন লাল পতাকা দিয়ে ডিএমটিসিএলের নিয়োজিত কর্মীরা মানুষকে পারাপারে সহায়তা করছেন। এটা আরও জোরদার করা হবে। এরপর পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে মানুষের যাতায়াত কীভাবে সহজ করা যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তাদের বেশির ভাগই পথচারী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৩৭ জন। এর মধ্যে পথচারী সাড়ে ৫২ শতাংশ।
গ্রিন রোড থেকে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের সড়ক দিয়ে কারওয়ান বাজারে নিজের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করেন ফাহমিদা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটিতে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলাচল করে। মোটরসাইকেলের চালকদের অনেকেই বেপরোয়া। এর মধ্যেই পারাপার হতে হয়।
ফাহমিদা আরও বলেন, যানজট যখন থাকে, তখন যানবাহনের ফাঁক দিয়ে আতঙ্ক নিয়ে পারাপার হতে হয়, কখন আবার সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। কারওয়ান বাজারে ছিনতাইকারীরা ব্যাগ ধরে টান দিয়ে পালায়, সেই ঝুঁকিও রয়েছে।