আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা, শিক্ষার্থীদের পিটুনি, সাংবাদিকদের ওপর হামলা-দুর্ব্যবহারসহ বিভিন্ন আচরণে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। এসব ঘটনায় কোনো শাস্তি না হওয়ায় পুলিশের এই কর্মকর্তা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করে গত শনিবার রাতে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে শাহবাগ থানায় ধরে নিয়ে পেটানোর পর পুলিশের রমনা বিভাগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো এই কর্মকর্তাকে। রোববার দুপুরের পর এডিসি হারুনকে রমনা থেকে প্রত্যাহার করে ডিএমপির দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলির কথা জানানো হয়।
গত ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের মারধর করে পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি হারুন। মারধরের পরদিন সুপ্রিম কোর্ট ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম কার্যালয়ে যান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। সেখানে সাংবাদিকেরা পুলিশের জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন এডিসি হারুনকে সতর্ক করার জন্য। ওই বৈঠক চলাকালে টেলিফোনে ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকারের কাছে সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
এর আগে গত বছরের ৭ আগস্ট জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা করে পুলিশ। এতে বাম সংগঠনগুলোর অন্তত ২০ নেতা-কর্মী আহত হন। সেখানেও পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি হারুন।
গত বছরের এপ্রিলে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী-দোকানকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায়ও এডিসি হারুনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই সংঘর্ষে দুজনের প্রাণহানি হয়, আহত হন অনেকে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তখন অভিযোগ করা হয়েছিল, রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদ ও নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ুম ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ সময় উত্তেজিত ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও হকাররা ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে মুহুর্মুহু হামলা চালান। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ বিনা উসকানিতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও গুলি করে। ওই ঘটনায় এডিসি হারুনসহ পুলিশের রমনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের দাবি করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
সংঘর্ষ থামাতে যাওয়া এক পুলিশ কনস্টেবল ‘গুলি শেষ হয়ে গেছে’ বলায় এডিসি হারুন অর রশিদ তাঁকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হারুনের এ ধরনের আচরণের নিন্দা জানান বহু মানুষ।
এর বছরখানেক আগে ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠনের ডাকা মশালমিছিলে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে হামলা হয়। এসব ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনকারী, বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং বাম ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয় এডিসি হারুনের নেতৃত্বে। কয়েকটি ঘটনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও হারুনের কিছুই হয়নি।
বেশির ভাগ ঘটনাতেই এডিসি হারুন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। উল্টো তিনি দাবি করেছিলেন যে আন্দোলনকারীরাই পুলিশের ওপর হামলা করেছেন। কখনো কখনো বলেছেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ছাত্র ছিলেন হারুন অর রশিদ। ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে তিনি পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এডিসি হারুন বারবার সমালোচিত হলেও বহাল তবিয়তেই দায়িত্বে ছিলেন।
সর্বশেষ শনিবার রাতে ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম পেটান এডিসি হারুন। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলার মধ্যে রোববার দুপুরে হারুনকে রমনা থেকে প্রত্যাহারের কথা জানায় ডিএমপি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হকের স্ত্রীর সঙ্গে এডিসি হারুনের সখ্য আছে। আজিজুল হকের স্ত্রীও পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। আজিজুল হকের বাড়ি গাজীপুর জেলায়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক শরিফ আহমেদের গ্রামের বাড়িও গাজীপুরে।
আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আজিজুল হক তাঁর এলাকার বড় ভাই। তাঁদের বাড়ি গাজীপুরে। শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাঁকে ঢাকার শাহবাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে যেতে বলেন। রাত আটটার দিকে তাঁরা সেখানে যান।
এ সময় তাঁদের সঙ্গে হারুনের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে এডিসি হারুন সেখান থেকে সরে যান। পরে একদল পুলিশ দিয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে ধরে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান হারুন।
শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার ও শরিফকে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে বেদম মারধর করা হয় বলে জানান নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে আনোয়ারের আঘাত গুরুতর। তাঁর বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে গেছে। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে শরিফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হলে ফিরে গেছেন।
ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা আটক হওয়ার খবর পেয়ে শনিবার রাতে শাহবাগ থানার সামনে ভিড় করেন ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। থানার ভেতরে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ। পরে আনোয়ার ও শরিফকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ফেসবুকে এডিসি হারুনের কড়া সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
মারধরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে রোববার দুপুরে এডিসি হারুনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে প্রথম আলোর আরেক প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা অনুসন্ধান করে বের করেন।’
এদিকে এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শনিবার রাত থেকেই ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৎপরতা ছিল। এ বিষয়ে কথা বলতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে হারুনকে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়।