রাজউক ভবন
রাজউক ভবন

রাজউক থেকে ৩০ হাজার গ্রাহকের নথি গায়েব

যেসব গ্রাহকের নথি হারিয়েছে তঁারা ২০১৯ সালের মে থেকে চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিলেন।

  • ঘটনার তিন সপ্তাহ পরও রাজউক কোনো তদন্ত কমিটি করেনি। 

  • নথি হারিয়ে যাওয়ায় গ্রাহকেরা ভোগান্তির শিকার হতে পারেন। 

  • দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হতে পারে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সার্ভার থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদনসংক্রান্ত প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের আবেদনের নথিপত্র গায়েব হয়ে গেছে। ৬ ডিসেম্বর বিষয়টি প্রথম জানতে পারে রাজউক।

এটি নিছক কারিগরি ত্রুটি, নাকি এ ঘটনায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জড়িত, সে বিষয়ে এখনো অন্ধকারে রাজউক। অন্যদিকে এই বিপর্যয়ের কারণ উদ্‌ঘাটনে রাজউকের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ঘটনার তিন সপ্তাহ পরও সরকারি এই সংস্থা কোনো তদন্ত কমিটিও করেনি।

যেসব গ্রাহকের নথিপত্র হারিয়েছে, তাঁরা ২০১৯ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিলেন। রাজউকেরই কিছু কর্মকর্তা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এসব নথি হারিয়ে যাওয়ার কারণে ওই গ্রাহকেরা নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে পারেন।

হারিয়ে যাওয়া সব নথি পুনরুদ্ধারে তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই ঘটনায় থানায় জিডিও (সাধারণ ডায়েরি) করেছেন তাঁরা।
কাজী মোহাম্মদ মাহাবুবুল হক, রাজউকের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখার প্রধান

একই সঙ্গে দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হতে পারে। যেমন অনেকেই ভবন বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চান। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নথিপত্র যাচাইয়ের জন্য রাজউকে চিঠি পাঠায়। নথি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ওই গ্রাহকের ব্যাংকঋণ পেতে সমস্যা হবে। কারণ, ব্যাংকে জমা দেওয়া গ্রাহকের নথি ঠিক আছে কি নেই, সেটি যাচাই–বাছাই করার সুযোগ রাজউকের থাকছে না।

অন্যদিকে নথি হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে কোনো গ্রাহক চাইলে রাজউক অনুমোদিত মূল নকশা ঘষামাজা করে অনিয়ম করতে পারবেন। এতে রাজউকের বাধা দেওয়ার সুযোগও কম থাকবে। কারণ, চ্যালেঞ্জ করার মতো নকশা এখন রাজউকে নেই। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ভবনের উচ্চতা বাড়ালেও রাজউক ধরতে পারবে না—বলছেন রাজউকের কর্মকর্তারা।

রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণের অনুমোদন নিতে হয়। আগে সনাতন পদ্ধতিতে কাজটি হতো। ২০১৬ সালে প্রাথমিকভাবে রাজউকের আটটি অঞ্চলের মধ্যে শুধু একটি অঞ্চলে (অঞ্চল-৫) ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করে রাজউক। ২০১৮ সালে সব অঞ্চলে অনলাইনে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দেওয়া শুরু হয়। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের পাশাপাশি নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার কাজটিও শুরু হয়।

অনলাইনে এ কাজ করতে ব্যবহার করা হয় এই ওয়েবসাইট। এখানে গিয়ে নিবন্ধন করে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন করতে হয় গ্রাহককে। ভবনের নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র গ্রাহককে এই ওয়েবসাইটেই আপলোড করতে হয়।

পরে যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে এই ওয়েবসাইটেই ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও রাজউক অনুমোদিত ভবনের নকশা আপলোড করা হয়। এগুলো ডাউনলোড করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেন গ্রাহক। রাজউক সূত্র জানায়, ৬ ডিসেম্বর হঠাৎ এই ওয়েবসাইট অকার্যকর হয়ে যায়। রাজউকের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখার প্রধান কাজী মোহাম্মদ মাহাবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হারিয়ে যাওয়া সব নথি পুনরুদ্ধারে তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই ঘটনায় থানায় জিডিও (সাধারণ ডায়েরি) করেছেন তাঁরা।

‘গ্রাহকদের হারিয়ে যাওয়া তথ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই বিভাগের সিনিয়র সচিব আশ্বস্ত করেছেন, সব তথ্য পুনরুদ্ধার করা যাবে।’
আনিছুর রহমান মিঞা, রাজউকের চেয়ারম্যান

অনিয়মের শঙ্কা

ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য রাজউকের প্রণয়ন করা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গত ২৩ আগস্ট অনুমোদন দেয় সরকার। এর কারণে রাজউকের আওতাধীন বেশির ভাগ এলাকায় আগের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে জমির মালিকদের।

পরে জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক সিদ্ধান্ত নেয়, যাঁরা ২৩ আগস্টের আগে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাঁরা আগের নিয়মে ভবন নির্মাণ করতে পারবেন, অর্থাৎ বর্তমান ড্যাপে উল্লিখিত আয়তনের চেয়ে বেশি আয়তন পাবেন। ৪ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রাজউক। এর এক দিন পরেই রাজউকের ভবন নির্মাণসংক্রান্ত ওয়েবসাইটটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

রাজউক সূত্র বলছে, ২৩ আগস্টের আগের তারিখে আবেদন দেখানোর জন্যও একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ওয়েবসাইটটি অকার্যকর করতে পারে।

আগের প্রতিষ্ঠানেই ভরসা

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (টেকনোহ্যাভেন কোম্পানি লিমিটেড) সহযোগিতায় ওয়েবসাইট পরিচালনার কাজটি করে আসছে রাজউক। ওই প্রতিষ্ঠান এখনো রাজউককে জানাতে পারেনি কেন ওয়েবসাইটটি অকার্যকর হয়েছিল এবং কেন নথিগুলো গায়েব হলো। তবে ২২ ডিসেম্বর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ওয়েবসাইটে নতুন করে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন নিচ্ছে রাজউক।

ওয়েবসাইট হঠাৎ অকার্যকর হয়ে প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের তথ্য কীভাবে খোয়া গেল, জানতে চাইলে টেকনোহ্যাভেন কোম্পানি লিমিটেডের সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার রূহুল আমিন গতকাল বুধবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে রাজউকের এমআইএস বিভাগ ভালো বলতে পারবে।’

নথি গায়েবের সঙ্গে টেকনোহ্যাভেনের কেউ জড়িত থাকতে পারেন, রাজউকের কিছু কর্মকর্তার এমন সন্দেহের বিষয়ে সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার রূহুল আমিন বলেন, ‘এটি অসম্ভব ব্যাপার। আমরা বিষয়টি (ওয়েবসাইট) লালনপালন করছি। আমরা এর সঙ্গে জড়িত থাকব তা অসম্ভব।’

রাজউকে একটি অংশ থেকে দাবি উঠেছিল, আগে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হোক। আর অন্তর্বর্তী সময়ে সনাতন পদ্ধতিতে অথবা রাজউকের ‘আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের’ আওতায় তৈরি করা ওয়েবসাইটের কার্যক্রম চালানো হোক। কিন্তু কোনো বিকল্প পথে যায়নি রাজউক।

রাজউকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিপিএস) তৈরি করা আছে। পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য গত বছর এই সিস্টেমের উদ্বোধনও করা হয়েছে। কিন্তু অজানা কারণে রাজউক ইসিপিএস ব্যবহার না করে আগের ওয়েবসাইটে আবার নতুন করে কাজ করছে।

রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রাহকদের হারিয়ে যাওয়া তথ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই বিভাগের সিনিয়র সচিব আশ্বস্ত করেছেন, সব তথ্য পুনরুদ্ধার করা যাবে।’ কেন এ ঘটনা ঘটল, তা জানতে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এখনো আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয়কে লিখেছি, তাদের বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে।’