পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা এখন আর বলতে চান না সাজ্জাদ হোসেন। ওই আগুনে পুড়ে মারা যান তাঁর ভাই আনোয়ার হোসেন। ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের সড়কের উল্টো পাশেই ছিল তাঁদের ওষুধের দোকান। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেটিও।
চুড়িহাট্টায় সেই অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চারতলা হাজি ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে লাগা আগুনে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭১ জন। আগুন আশপাশের কয়েকটি ভবনেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৪ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিল ফায়ার সার্ভিস।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওই ঘটনায় তাঁদের পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পৈতৃক জমি বিক্রি করে দেড় বছর আগে আবার দোকান দিয়েছেন। মৃত ভাইয়ের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য অনেক সহায়তা এসেছে এমন খবর শুনেছেন। তবে তাঁরা কিছুই পাননি।
ওই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে চুড়িহাট্টা এলাকায় আবার ব্যবসা শুরু করেছেন। তবে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা না পাওয়ায় তাঁরা হতাশ। এমনই একজন মফিজুল ইসলাম। তাঁর দোকান ছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় পশ্চিম দিকে। মফিজুল প্রথম আলোকে বলেন, দোকান পুড়ে যাওয়ার পর পাঁচ বছর তিনি পথে পথে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো সহায়তা পাননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি কাউন্সিলর ছিলেন না। তবে যত দূর জেনেছেন, অনেকে সহায়তা পেয়েছেন। আবার অনেকের স্বজনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে চাকরিও দেওয়া হয়েছে।
ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটির তিনতলা ও চারতলা আবাসিক ছিল। তিনতলার দেয়ালে এখনো আগুনের ছাপ লেগে আছে। ওই তলার সংস্কারকাজ শেষ হয়নি। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চারতলা সংস্কারকাজ শেষ করা হয়েছে।
গত শুক্রবার দুপুরে চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলা বেসরকারি দুটি ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নিচতলায় দুটি দোকান বাদে বাকি সব দোকানি নতুন। নিচতলায় কয়েকটি দোকান এখনো ভাড়া হয়নি। দোকানিরা বলছেন, বড় দুর্ঘটনার পর অনেক ব্যবসায়ী এই ভবনে দোকান ভাড়া নিতে চাচ্ছেন না।
ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটির তিনতলা ও চারতলা আবাসিক ছিল। তিনতলার দেয়ালে এখনো আগুনের ছাপ লেগে আছে। ওই তলার সংস্কারকাজ শেষ হয়নি। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চারতলা সংস্কারকাজ শেষ করা হয়েছে।
ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই সহোদর মো. হাসান ও মো. সোহেল। তাঁদের আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেছিলেন চুড়িহাট্টার আগুনে নিহত চকবাজারের ওয়ার্কস রোডের বাসিন্দা জুম্মন আলীর (৫২) ছেলে মো. আসিফ। তিনি মামলায় অভিযোগ করেছিলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য বেশি টাকায় ভবন ভাড়া দিয়েছিলেন দুই ভাই।
এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে—ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ভবনটির রাসায়নিকের গুদাম থেকে। তদন্ত কমিটি জরুরি ভিত্তিতে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সে অনুযায়ী রাজধানীর শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ কারখানার জমিতে ৫৮ কোটি টাকা খরচ করে অর্ধশতাধিক রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ করে শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা রাসায়নিকের গুদামগুলো সেখানে সরিয়ে নিচ্ছেন না।
একের পর এক অগ্নিকাণ্ড হলেও মিটফোর্ড ও আরমানিটোলা এলাকা থেকে বেশির ভাগ রাসায়নিকের গুদাম সরেনি। কোনটি দাহ্য পদার্থ বা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর কোনটি কম ঝুঁকিপূর্ণ—এ বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তাই অনেকে ঝুঁকি জেনেও ভবনের মধ্যে গুদাম ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।ইমরান হোসেন, চুড়িহাট্টার বাসিন্দা
চুড়িহাট্টা এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই সিটি করপোরেশন এলাকায় কতটি রাসায়নিকের গুদাম আছে, তা নিয়ে ২০২০ সালের শেষের দিকে জরিপ করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় করা ওই জরিপে কেবল ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে রাসায়নিকের গুদাম খুঁজে পাওয়া যায় ১ হাজার ৯২৪টি। এসব গুদামের মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
ওই জরিপকাজে যুক্ত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মুনিরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কেবল তালিকা তৈরির কাজে ছিলেন। তাঁর ধারণা, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলো এখনো সরানো হয়নি।
চুড়িহাট্টার ঘটনার দুই বছর পর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় হাজি মুসা ম্যানশন নামের একটি ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এ এলাকার ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একের পর এক অগ্নিকাণ্ড হলেও মিটফোর্ড ও আরমানিটোলা এলাকা থেকে বেশির ভাগ রাসায়নিকের গুদাম সরেনি। কোনটি দাহ্য পদার্থ বা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর কোনটি কম ঝুঁকিপূর্ণ—এ বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা কম। তাই অনেকে ঝুঁকি জেনেও ভবনের মধ্যে গুদাম ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। গত শনিবার মিটফোর্ড, আরমানিটোলা ও চকবাজার এলাকা ঘুরে বহু রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম দেখা যায়।
শ্যামপুরের প্রতিটি গুদামের আকার ১ হাজার ৪৪৪ বর্গফুট। কিন্তু গুদামের জন্য বরাদ্দ অফিস, সামনের খোলা জায়গা, নিরাপত্তাচৌকি, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, গভীর নলকূপ, পানির ট্যাংক ইত্যাদিসহ মোট ২ হাজার ৫৬ বর্গফুট জায়গার জন্য ভাড়া দিতে হবে ব্যবসায়ীদের।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাসায়নিকের গুদামগুলো এক জায়গায় আনতে শ্যামপুরে অস্থায়ী রাসায়নিক গুদাম উদ্বোধন করা হয় গত বছরের ৪ জুন। এই গুদাম তৈরি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি) সূত্রে জানা যায়, শ্যামপুরে মোট ৫৪টি গুদাম তৈরি করা হয়েছে। বারবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র একটি গুদামঘর ভাড়া হয়েছে। এ ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠান ভাড়া নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে পরিমাণ গুদাম প্রয়োজন সে তুলনায় শ্যামপুরে গুদামের সংখ্যা অনেক কম। আর অস্থায়ী গুদামের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তা-ও বেশি। তবে বিসিআইসি বলছে, সার্বিক সুযোগ-সুবিধা ও বাজারদর হিসাব করেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
শ্যামপুরের প্রতিটি গুদামের আকার ১ হাজার ৪৪৪ বর্গফুট। কিন্তু গুদামের জন্য বরাদ্দ অফিস, সামনের খোলা জায়গা, নিরাপত্তাচৌকি, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, গভীর নলকূপ, পানির ট্যাংক ইত্যাদিসহ মোট ২ হাজার ৫৬ বর্গফুট জায়গার জন্য ভাড়া দিতে হবে ব্যবসায়ীদের।
পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সুযোগ দিলে তাঁরা কি যাবেন? ট্যানারি তো ঢাকা থেকে চলে গেছে। কারণ সরকার চেয়েছে। সুযোগ দিয়ে রাখলে কেউ পুরান ঢাকা থেকে সরবে না। বন্ধ করে দেওয়া হলে সবাই যাবে।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান
২০২৩ সালে প্রথম দফায় ভাড়ার বিজ্ঞপ্তিতে প্রতি বর্গফুটের জন্য মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৭০ টাকা। সে হিসাবে একটি গুদামের জন্য মাসে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভাড়া আসে। এর সঙ্গে বিভিন্ন পরিষেবা খরচ বাবদ আরও অন্তত ২০ হাজার টাকা যুক্ত হওয়ার কথা। ওই বছর ভাড়ার আবেদনে কোনো সাড়া দেননি ব্যবসায়ীরা।
এরপর গত বছরের ১০ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তাতে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩৮ টাকা করা হয়। এরপরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গুদাম ভাড়ার জন্য কেউ আবেদন করেনি।
ব্যবসায়ীরা কেন পুরান ঢাকা ছাড়ছেন না—এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ও পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, পুরান ঢাকায় এখন আর রাসায়নিক গুদাম তেমন নেই। ব্যবসায়ীরা বিক্রমপুর, গাজীপুর, টঙ্গী, বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জসহ অন্যান্য জায়গায় ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা কেন শ্যামপুরের গুদামে যাচ্ছেন না, সে প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা বর্তমানে যেসব জায়গায় ব্যবসা করছেন সেখানে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা। শ্যামপুরের গুদাম তাদের জন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে একটু উল্টো হয়ে গেছে। সেখানে পণ্য আনা নেওয়ার খরচ বেশি পড়ে। আবার এলসি বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা মালামাল আনতে পারছে না। এসব কারণে হয়তো শ্যামপুরের গুদামে তাঁরা যেতে চাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বিসিআইসির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানের মুঠোফোনে কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
রাসায়নিকের গুদাম এখনো না সরার জন্য সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি দেখছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সুযোগ দিলে তাঁরা কি যাবেন? ট্যানারি তো ঢাকা থেকে চলে গেছে। কারণ সরকার চেয়েছে। সুযোগ দিয়ে রাখলে কেউ পুরান ঢাকা থেকে সরবে না। বন্ধ করে দেওয়া হলে সবাই যাবে।