সমাজে যখন অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হচ্ছে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা সীমিত হয়ে আসছে-এমন সংকটময় কালে কলিম শরাফীর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকার মতো। দেশের সংস্কৃতিচর্চা, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের আন্দোলনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আজ বুধবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সংগীত আবৃত্তি ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে বরেণ্য শিল্পী, সংগঠক ও সংস্কৃতিজন কলিম শরাফীর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গান, আবৃত্তি, স্মৃতিচারণা দিয়ে সাজানো এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল শিল্পী কলিম শরাফীর জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’ শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শনী দিয়ে। এটি নির্মাণ করেছেন নিশাত জাহান খান। এরপর ছিল মিলনায়তনের সামনে প্রদীপ ও ফুল দিয়ে সাজানো কলিম শরাফীর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ, মহানগর সংসদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ ও খেলাঘর আসরের নেতারা।
কলিম শরাফীর সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বেলায়েত হোসেন। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় কলিম শরাফীর জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ মে। পড়ালেখা কলকাতায়। ছাত্র বয়সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন এবং বাম নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করা হয়নি। বিখ্যাত ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, মৃণাল সেন, শম্ভু মিত্রসহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে তিনি কাজ করেছেন।
বর্ণাঢ্য জীবন কলিম শরাফীর। দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। রেডিও, টেলিভিশন, গ্রামোফোন কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের প্রান্তিক নবনাট্য আন্দোলন, জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ (পরে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ), রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, সংগীত ও নৃত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংগীত ভবনসহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলেন। উদীচীর সঙ্গে তাঁর যুক্ততা ছিল দীর্ঘ দিনের, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
বক্তারা কলিম শরাফীর জীবনের এই বহুমাত্রিক কর্মময় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, বহুগুণে গুণী মানুষ কলিম শরাফী সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তিনি একটি বৈষম্যহীন, মুক্ত সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। হৃদয়ে রবীন্দ্রসংগীত ধারণ করে তিনি গণমানুষকে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে গণসংগীত গেয়েছেন। সারওয়ার আলী বলেন, সমাজে যখন অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হচ্ছে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা সীমিত হয়ে আসছে, এমন সংকটময় সময় কলিম শরাফীর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন ছিল।
সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, সত্যকে ধারণ করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে মানুষকে তিনি মুক্তির অভিযাত্রায় সংগঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকার মতো।
আলোচনায় আরও অংশ নেন শিল্পী আবদুল মান্নান, সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সহসভাপতি শিল্পী বিশ্বজিৎ রায়। সভাপতির বক্তব্যে উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান শিল্পী কলিম শরাফীর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী পুস্তক আকারে প্রকাশ ও দেশের সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে কলিম শরাফীর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠান আয়োজনের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আলোচনা পর্বের আগে উদীচীর শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে ‘অবাক পৃথিবী’, ‘বিদ্রোহ আজ’, ‘ভয়ের রাজ্যে থাকব না’ গানগুলো গেয়ে শোনান। ‘আকাশভরা’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন নেওয়াজ মৃণ্ময় রহমান। উদীচীর আবৃত্তি দল পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুপ্রভাত’ কবিতা। একক সংগীতে শিল্পী মহাদেব ঘোষ পরিবেশন করেন ‘আমি চঞ্চল হে’, মায়েশা সুলতানা পরিবেশন করেন ‘সূর্যস্নান’ সিনেমায় কলিম শরাফীর গাওয়া বিখ্যাত গান ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।