রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ১ নম্বর সড়কের মুখে এ ফুসফুস লাগানো হয়েছে। পথচারীরা বেশ কৌতূহল নিয়েই তাকাচ্ছেন এর দিকে।
নয়তলা ভবনটির সামনে লাল রঙের একটি বোর্ড। এটির বুকজুড়ে কাপড়ের তৈরি এক জোড়া ফুসফুস, একটু একটু করে কাঁপছে। যেন কেউ নিশ্বাস নিচ্ছে অনবরত। কাপড়ের রং অনেকটা বাদামি। অথচ আট দিন আগে এ কৃত্রিম ফুসফুস লাগানোর দিনও ধবধবে সাদা ছিল এর রং।
রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ১ নম্বর সড়কের মুখে এ ফুসফুস লাগানো হয়েছে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটা পথচারীরা বেশ কৌতূহল নিয়েই তাকাচ্ছেন এর দিকে।
এমনই একজন আবদুল্লা হিল আকবর। চাকরিসূত্রে এ তল্লাটে প্রায় দু-এক দিন পরপরই আসেন তিনি।
আকবর বলছিলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই খেয়াল করতেছি বোর্ড আর ফুসফুসটা। দিন দিন ধুলা জমতেছে কাপড়ের ফুসফুসে। হয়তো এটা বোঝানোর জন্যই এটা করা হইছে।’
তাদের প্রধান কার্যালয়ের সামনেই লাগানো হয়েছে লাল বোর্ড আর ফুসফুস। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘সেভ ইয়োর ব্রেদস’ বা ‘আপনার নিশ্বাস নিরাপদ’ করুন।
বায়ুদূষণে নাকাল ঢাকা ও এই নগরীর মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বের ১১০টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ঢাকা ছিল সপ্তম স্থানে (রাত সাড়ে ১১টায়)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন—হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের ‘এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস’ ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান পঞ্চম। দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৯ সালে রাজধানীতে ২২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বায়ুদূষণে আক্রান্ত হয় আমাদের শরীরের শ্বাস–প্রশ্বাসের প্রধান অঙ্গ ফুসফুস। একে আমরা দেখতে পাই না। তাই কতটা এর ক্ষতি হচ্ছে—তা বুঝতেই মডেল ফুসফুস লাগানোর উদ্যোগ। উদ্যোক্তা শক্তি ফাউন্ডেশন নামের বেসরকারি সংগঠন। তাদের প্রধান কার্যালয়ের সামনেই লাগানো হয়েছে লাল বোর্ড আর ফুসফুস। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘সেভ ইয়োর ব্রেদস’ বা ‘আপনার নিশ্বাস নিরাপদ’ করুন।
শক্তি ফাউন্ডেশনের পরামর্শক লাবিবা রহমান বলছিলেন, ‘ঢাকায় দূষণের যেসব উপাদান আছে, সেগুলো সরাসরি ঢুকছে আমাদের ফুসফুসে। আমরা কাপড় দিয়ে ফুসফুস বানিয়ে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এটা প্রতীকীভাবে তুলে ধরবে আমাদের ভেতরে আসলে কী পরিমাণ দূষণ ঘটছে।’
ভারতের নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, লক্ষ্ণৌ, মুম্বাই ও লুধিয়ানা এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে এর আগে এভাবে কৃত্রিম ফুসফুস লাগিয়ে দূষণ দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল।
শক্ত ধাতবের বোর্ডের ওপর সাদা কাপড় দিয়ে বানানো হয়েছে ফুসফুস। পাতলা তার দিয়ে তৈরি কাঠামোর ওপর কাপড় জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে এটি ঠিক থাকে। এর পেছনে লাগানো আছে এগজস্ট ফ্যান। এর বাতাসে কাপড় ওঠানামা করছে। আবার ধূলিকণাও ধরে রাখা সহজ হচ্ছে।
কৃত্রিম এই ফুসফুসের কাঠামো তৈরির বর্ণনা দিয়ে শক্তি ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সাব্বির আহমেদ ওসমানী বলছিলেন, ‘এর আগে ভারতের একাধিক শহরে ও নেপালের কাঠমান্ডুতে এভাবে ফুসফুস লাগিয়ে দূষণ পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে থেকে এ–সংক্রান্ত ধারণা নিয়েছি।’
এই ফুসফুস যে কাপড়ে তৈরি, তার রঙের পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে সাদা রং বাদামি হয়। একসময় কালো হয়ে যায়। কী পরিমাণ দূষিত উপাদান কাপড়ে পড়ছে, তা বুঝতে প্রতিদিন এর ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। গত ৩১ অক্টোবর এই কৃত্রিম ফুসফুস লাগানো হয়েছে। এই প্রতিবেদক এটি দেখতে যান ৮ নভেম্বর। দেখা যায়, সাদা কাপড় তখন অনেকটাই বাদামি।
ভারতের নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, লক্ষ্ণৌ, মুম্বাই ও লুধিয়ানা এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে এর আগে এভাবে কৃত্রিম ফুসফুস লাগিয়ে দূষণ দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল।
পিএম ২.৫ এর মধ্যে নানা জৈব ও অজৈব উপাদান। আছে ভারী ধাতু। এসব এই কৃত্রিম ফুসফুসে নির্ণয় করা হয়তো যাবে না। কিন্তু এতে যে আস্তরণ পড়ছে, তাতে দূষণের একটা অনুমান করা যায়। তাই এই বানানো ফুসফুসের প্রতীকী গুরুত্ব যথেষ্ট।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম
যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণকাজের সময় তৈরি হওয়া ধুলা, কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত রাসায়নিক, ইটভাটার ধোঁয়া—ঢাকার বায়ুদূষণের কয়েকটি উৎস। আর দূষণের উপাদানের মধ্যে মুখ্য পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, পিএম ২.৫ এর মধ্যে নানা জৈব ও অজৈব উপাদান। আছে ভারী ধাতু। এসব এই কৃত্রিম ফুসফুসে নির্ণয় করা হয়তো যাবে না। কিন্তু এতে যে আস্তরণ পড়ছে, তাতে দূষণের একটা অনুমান করা যায়। তাই এই বানানো ফুসফুসের প্রতীকী গুরুত্ব যথেষ্ট।
শক্তি ফাউন্ডেশন ঢাকার আরও পাঁচ জায়গায় এমন বানানো ফুসফুস স্থাপন করতে চায়। এসব ফুসফুসে বায়ুদূষণের মাত্রার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সতর্কবার্তাও থাকবে। দূষণের ফলে ফুসফুসের এই হালের তথ্য পৌঁছানো হবে নীতি নির্ধারণী স্তরে—জানান শক্তি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা লাবিবা রহমান।