রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের সময় কয়েকজনকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। সংঘর্ষের ঘটনায় চার ঘণ্টা ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশে যান চলাচল বন্ধ ছিল। গতকাল দুপুরে
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের সময় কয়েকজনকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। সংঘর্ষের ঘটনায় চার ঘণ্টা ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশে যান চলাচল বন্ধ ছিল। গতকাল দুপুরে

৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি, বলছেন অধ্যক্ষ

দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলা ও ভাঙচুরে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ। সংঘর্ষ ও মারধরে অন্তত ২৫ জন আহত।

হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে অবস্থিত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ। গতকাল সোমবার কলেজটিতে হামলা চালান পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শত শত শিক্ষার্থী।

পরে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী হামলাকারীদের ধাওয়া দেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষ ও মারধরে আহত হন অন্তত ২৫ জন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ঘটনার পর গতকাল সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ঘটনাটিকে পরিকল্পিত ও সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে অভিহিত করেছেন পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ছালেহ উদ্দিন। তিনি বলেন, মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা ছাত্র বেশে হামলা চালিয়ে কোটি টাকার মালামাল লুটপাট করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়ের দিক থেকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে এসে জড়ো হতে থাকেন। এরপর বেলা একটা পর্যন্ত তাঁরা কলেজের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। পরে বেলা একটার দিকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী মিলে হামলাকারীদের ধাওয়া দেন। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুরান ঢাকার কলেজ দুটির শিক্ষার্থীরা যাত্রাবাড়ী এলাকা ত্যাগ করেন।

মাতুয়াইল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা নাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী আসার আগেই ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।

ঘটনাস্থলে থেকে দেখা যায়, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ভেতরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী আটকা পড়েন। পরে তাঁদের ব্যাপক মারধর করা হয়। বেলা দুইটার দিকে অন্তত তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় কলেজের ভেতর থেকে বের করতে দেখা গেছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় গত রোববার। ওই দিন ‘ভুল চিকিৎসায়’ অভিজিৎ হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর দাবি করে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির নামে এই হামলা চালানো হয়। শিক্ষার্থী, প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের দিনের হামলার জের ধরে গতকাল ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি দিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালানো হয়।

মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন সাংবাদিকদের বলেন, রোববার রাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছিল মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ গুঁড়িয়ে দেবেন। কিন্তু এমন ধ্বংসযজ্ঞ শিক্ষার্থীরা চালাবে, এটা কল্পনা করা যায় না। এই হামলায় ছাত্র, অছাত্র ও ভাড়াটে লোকেরা অংশ নিয়ে নৈরাজ্য করেছে। তিনি বলেন, তাঁদের কলেজের ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হামলাকারীরা শিক্ষার্থীদের সনদ ও ২০-৩০টি ল্যাপটপ নিয়ে গেছে। সব বৈদ্যুতিক পাখা ও পাঁচটি লিফট নষ্ট করেছে। ভবনের জানালা অক্ষত নেই।

কলেজের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ

সংঘর্ষ থামার পর বেলা দুইটার দিকে এই প্রতিবেদক মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে প্রবেশ করার সুযোগ পান। ভেতরে ঢুকেই দেখা যায়, বাঁ পাশের অভ্যর্থনা কেন্দ্র বা ফ্রন্ট ডেস্ক এবং ডান পাশে পাঠাগার পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানকার আসবাব ভেঙে ফেলা হয়েছে। মেঝেজুড়ে ভাঙা কাচের টুকরা। কলেজ ভবনের অফিস কক্ষ, শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি (পরীক্ষাগার), অধ্যক্ষের কক্ষ ও প্রশাসনিক কক্ষের আসবাব ও অন্যান্য সরঞ্জাম ক্ষতি করা হয়েছে।

মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কলেজে থাকা টাকাও লুট করা হয়েছে। তবে কত টাকা নিয়ে গেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাতুয়াইল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের অনেক শিক্ষার্থী কম্পিউটার, আসবাব, বৈদ্যুতিক পাখাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম হাতে যাত্রাবাড়ীর দিকে যাচ্ছেন। তাঁদের অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা প্রত্যেকেই বলেছেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও লুটপাটের ঘটনার ‘প্রতিশোধ’ নিতে তাঁরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী বিজয় আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল (রোববার) মাহবুবুর রহমান কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের কলেজে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। আমরা এর প্রতিশোধ নিতে এসেছি। মোল্লা কলেজে ঢুকে যা পেয়েছি, তা নিয়ে এসেছি।’

নিহতের তথ্য সঠিক নয়: পুলিশ

এদিকে হামলা ও সংঘর্ষের পর দুই পক্ষ থেকেই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দাবি করা হয়। তবে পুলিশ বলেছে, নিহতের যে তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, তা সঠিক নয়।

বিষয়টি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে অপপ্রচার থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়।

ডিএমপির বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আগের দিনের হামলার জেরে গতকাল সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের ১২ থেকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও বাহাদুর শাহ পার্কে জড়ো হন। এরপর বেলা ১১টার দিকে তাঁরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ বাধা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে এগিয়ে যান। যাত্রাবাড়ী মোড়ে পুলিশ আবার তাঁদের বাধা দেয়। সেই বাধা অতিক্রম করে তাঁরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান।

হামলা ও ভাঙচুর চালানোর পর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনের চিত্র। গতকাল বেলা পৌনে দুইটায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে

এদিকে গত রোববার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এলাকায় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও আটটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ঢাকার সূত্রাপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। গত রোববার পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে।

সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের সংঘাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের না জড়াতে আহ্বান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’

রাজধানীতে দুই দিনে তিনটি কলেজে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটল। গতকাল মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা ও সংর্ঘের সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশ দিয়ে যানবাহন চলাচল প্রায় চার ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এর আগে ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ‘ছাত্রসমাজের ঐকমত্যে চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনের’ লক্ষ্যে গতকাল রাতে বৈঠকে বসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে ভূমিকা পালনকারী, ফ্যাসিবাদবিরোধী ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। এ বৈঠকের উদ্যোগ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, হামলা, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে সরকার। এ ছাড়া সামনের দিনে আর এ ধরনের কোনো কার্যক্রম সহ্য করা হবে না।