জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার বাংলাদেশ করেছে, তা বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়। বাংলাদেশ একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে। ন্যায়বিচার করতে চাইলে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে হবে।
‘মানবতাবিরোধী অপরাধের এক যুগ: আলোচনা ও মূল্যায়ন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কথাগুলো বলেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান। আজ মঙ্গলবার সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস) এই সভার আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার অডিটরিয়ামে এই সভা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সমালোচনা করে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, তাদের যারা বন্ধু নয়, তাদেরই তারা বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে দূষিত করেছে। বাংলাদেশ তা করেনি। বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিজেরা করতে পেরে বাংলাদেশ মানুষ হত্যার বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের আপিলের সুযোগ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইসিসিতে সেই সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সব সুযোগ দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ মানবাধিকারের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র। বিশ্বের উচিত হবে বাংলাদেশের কাছে মাথা নত করে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দেওয়া।
সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ ফউজুল আজিম। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের একটি সারমর্ম তুলে ধরেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত এ আদালত থেকে ৫৩টি মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। এ আদালতের বিচারকদের যোগ্যতা, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠেনি। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল। এই বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল জামায়াতের সঙ্গেও বৈঠক করার সমালোচনা করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের যে সংজ্ঞা দেয়, সেটা কি তাদের সংজ্ঞা নাকি আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা। আন্তর্জাতিক আইন বলতে এখন যা বলা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে মার্কিন আইন নাকি ইউরোপিয়ান আইন। আন্তর্জাতিক আইন হতে গেলে এশিয়া, আফ্রিকাসহ সব জনগোষ্ঠী মিলে যে কাঠামো হবে সেটা হওয়ার কথা। তিনি আরও বলেন, গ্রিক, রামায়ণ, মহাভারতে যুদ্ধ, বিচারের বিষয় আছে। বিচারপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের অনুসরণ না করে নিজেদের গোড়ায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বলেন।
সভাপতির বক্তব্যে সিজিএসের পরিচালক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এই বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ ছিল, নানা বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। এই আদালতে সব নিয়ম, শর্ত ও বিচারের ন্যায্যতা মেনেই সম্পন্ন হয়েছিল। সুষ্ঠু সুন্দর একটি বিচার হয়েছে। অল্প সময়ে, অল্প খরচে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের যে বিচার করতে পেরেছে, তা এখন একটি উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে ১৯৫ জন মাস্টারমাইন্ড ছিলেন, তাঁদেরও বিচারের কাজ শুরু করতে হবে।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বীর প্রতীক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ জহির, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এমরান আজাদ।