শিশু সাদিকা সরকার সাফার বাবা প্রায় ১০ বছর ধরে নিখোঁজ। সে বাবাকে ফেরত চায়। বাবা যখন নিখোঁজ হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তিন মাস।
আজ শনিবার দুপুরে বাবার ছবি হাতে নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে অংশ নেয় সাদিকা। বাবার সন্ধান চেয়ে সরকারের কাছে আকুতি জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। একপর্যায়ে সাদিকা বলে, ‘আমি বাবাকে কখনো দেখিনি, বাবা বলে ডাকতে পারিনি। আমার একটাই দাবি, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি আর কিচ্ছু চাই না।’
সাদিকার বাবা মো. সোহেল রাজধানীর বংশাল থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর শাহবাগ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। তার পর থেকে আর খোঁজ মেলেনি।
সাদিকা মানববন্ধনে অভিযোগ করে, ‘২০১৩ সালে আমার বাবাকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, গুম করা হয়েছে।’
সাদিকার বাবার মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর আর খোঁজ মেলেনি, এমন অর্ধশত ব্যক্তির স্বজনেরা আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। তাঁরাও সাদিকার মতো স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়েছেন।
আগামীকাল রোববার বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ‘গুম-খুন, ক্রসফায়ার, কারা নির্যাতন বন্ধ করো! মানবাধিকার লঙ্ঘন রুখে দাঁড়াও!’ শীর্ষক এই মানববন্ধনের আয়োজন করে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। এই মানববন্ধন কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মানব প্রাচীর’।
আজ বেলা ১১টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই মানববন্ধন করার কথা ছিল। আয়োজকেরা বলছেন, পুলিশ তাঁদের শাহবাগে দাঁড়াতে দেয়নি। ‘বাধ্য’ হয়ে তাঁরা জাতীয় প্রেসক্লাবে এ কর্মসূচি পালন করেন।
এ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রব, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফায়জুল হাকিম প্রমুখ।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘মায়ের ডাক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। মায়ের ডাক শাহবাগে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে তাদের ধাক্কা দিয়ে বিদায় করা হয়েছে। পুলিশসহ এই সরকারের যত বাহিনী আছে, যত অত্যাচারই করুক, মায়ের ডাক তাদের লড়াই অব্যাহত রেখেছে। এই লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। গত ১০ বছরে এই প্রেসক্লাবে কতবার দাঁড়িয়েছি, কতবার কথা বলেছি, মানবতার ডাক সরকারের কানে যায়নি। এখন মানুষের সব মানবিক অধিকার হরণ করে, গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করে তামাশা করছে।’
সেলিমা রহমান বলেন, ‘স্বজনহারা হয়ে বেদনার কথা জানাতে এসেছেন, প্রতিবাদ করতে এসেছেন, সেই মাদের লড়াই দেখে আমি মুগ্ধ। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, তাঁরা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ দেখতে পাচ্ছি, কিভাবে এ্রই সরকার, মানুষের বুকের রক্তের ওপর দিয়ে, মানুষের লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।’
সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি অভিযোগ করেন, গুম-খুন চলছে, বিনা বিচারে হত্যা চলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কিংবা জেলের ভেতরে হত্যাকাণ্ড চলছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গায়েবি মামলা দিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হচ্ছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘কতজনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, অনতিবিলম্বে তাঁদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যাঁদের নিখোঁজ করেছেন, তাঁদের ফিরিয়ে দেন।’
‘মায়ের ডাকের’ সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের যেকোনো জায়গায় দাঁড়ানোর অধিকার আমাদের আছে। আজ শাহবাগে জাদুঘরের সামনে আমাদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এখানে গুমের শিকার সন্তানদের মায়েরা ছিলেন, আমরা যারা স্বজন রয়েছি, তারা ছিলাম। কোন কারণে আমাদের শাহবাগে দাঁড়াতে দেওয়া হলো না, সেটা সরকার জানে। সরকারের যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, তারা জানে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, এখানে (শাহবাগ) দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারব না। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুলিশ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
সানজিদা ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘এই সরকার গুম–খুনের বিচার তো করছেই না, উল্টো অন্যায়–অত্যাচার ও গণগ্রেপ্তার চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে, সেটা নেওয়ার মতো সাহস সরকারের নেই। আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার অধিকার নেই আমাদের। মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে আমরা আছি। আমাদের কথা শোনার মতো সাহসও নেই সরকারের।’
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শাহবাগে এখন কাউকেই এভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয় না। কারণ, শাহবাগ একটি ব্যস্ত এলাকা। কর্মসূচি পালনের নামে ক্রসিংয়ে যদি মানুষজন বসে পড়েন, তাহলে পুরো এলাকায় যানজট তৈরি হয়। সেখানে কেউ বসে পড়ার ঝুঁকি থাকলেই সরিয়ে দেওয়া হয়।