ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সা. সম্পাদককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা, ২৫ নেত্রীর গণপদত্যাগের হুমকি

ইডেন কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের কলেজ কমিটির ২৫ জন নেত্রী
ইডেন কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের কলেজ কমিটির ২৫ জন নেত্রী

রাজধানীর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রীভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা কলেজ প্রশাসনের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। বারবার নানা অপরাধ করার পরও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। এমন নানা অভিযোগ তুলে তাঁদের দুজনকে কলেজ ক্যাম্পাসে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ২৫ জন নেত্রী। শিগগিরই তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে গণপদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন তাঁরা।

আজ রোববার দুপুরে ইডেন কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাসের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এই হুমকি দেন ছাত্রলীগের কলেজ কমিটির ২৫ জন নেত্রী।

সিটবাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ায় গতকাল শনিবার রাতে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসকে আটকে রেখে হেনস্তা ও মারধরের অভিযোগ ওঠে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় গতকাল মধ্যরাত থেকেই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের অবস্থানে কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ঘটনা তদন্তে আজ সকালে ছাত্রলীগ একটি কমিটি করেছে। এ ছাড়া জান্নাতুল প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

আজ দুপুরে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৪৮ সদস্যের কমিটির সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের ২৫ জন নেত্রী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার ওরফে বৈশাখী। তিনি বলেন, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার উপস্থিতিতে তাঁদের অনুসারীরা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাসের সামনে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এ হামলায় জড়িত ব্যক্তিরা হলেন—সহসভাপতি নুজহাত ফারিয়া ওরফে রোকসানা, আয়েশা সিদ্দিকা ওরফে মীম, আর্নিকা তাবাসসুম ওরফে স্বর্ণা, শিরীণা আক্তার, সোমা মল্লিক ওরফে পপি, জিনাত হাসনাইন, লিমা ফেরদৌস আশরাফ লুবনা, বিজলী আক্তার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঋতু আক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুন নাহার ওরফে জ্যোতি ও ফারজানা ইয়াসমীন ওরফে নীলা। এই হামলার ঘণ্টাখানেক আগে জান্নাতুল ফেরদৌসের হলের কক্ষে তামান্না ও রাজিয়ার অনুসারীরা হামলা চালান। তখন তাঁর কক্ষে থাকা ল্যাপটপ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আত্মসাৎ করা হয়।

বিভিন্নভাবে ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, জান্নাতুল ফেরদৌসের ওপর হামলার সময় আয়েশা সিদ্দিকা ওরফে মীম ও নুজহাত ফারিয়া ওরফে রোকসানা জান্নাতুল ও তাঁর বোনের মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে তামান্না ও রাজিয়ার হাতে তুলে দেন। জান্নাতুল ফেরদৌসের গলায় থাকা স্বর্ণালঙ্কার, হাতব্যাগে থাকা ১৫ হাজার টাকা ও তাঁর ছোট বোনের হাতে থাকা আংটিও আত্মসাৎ করা হয়। এসব জিনিস জান্নাতুল এখনো বুঝে পাননি। সর্বোপরি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একচেটিয়া রাজনৈতিক আচরণে অতীষ্ট হয়ে আমরা বাকি নেতারা এর প্রতিবাদ করতে বাধ্য হই। আমাদের অনেক নেতা তাঁদের প্রতিহিংসার শিকার। তাঁদের অনুসারীদের নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে বারবার প্রশাসনকে জানালেও কোনো স্পষ্ট প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ক্যানটিনের চাঁদাবাজি, ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে চাঁদাবাজি, কলেজের মুদিদোকানে চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে শতাধিক কক্ষ দখল করে রাখা, বিভিন্নভাবে ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে তাঁদের (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী) বিরুদ্ধে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এসব জানানো হলেও তাঁদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। আমরা অনিরাপদ বোধ করছি। (হামলা-মারধর-হেনস্তার) ঘটনা বারবার ঘটছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

২৫ জন নেত্রীর পক্ষে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মার্জানা আক্তার ওরফে ঊর্মি। দাবিগুলো হলো—ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া; সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত হেনস্তার সুষ্ঠু বিচার; ক্যাম্পাসের যেকোনো সিসিটিভি ফুটেজ লোকানোর চেষ্টা বন্ধ করা; ‘মাতৃতুল্য অভিভাবক’ ইডেন কলেজের অধ্যক্ষকে (সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য) নিয়ে অকাট্য করে (অপমানজনক বক্তব্য) কথা বলার জবাব দেওয়া; একচেটিয়া রাজনীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; প্রত্যেক ছাত্রী যেন নিরাপদে থাকতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা; (তামান্না-রাজিয়ার অনুসারীদের) গণহারে শতাধিক কক্ষ দখলের হিসাব দেওয়া এবং জান্নাতুল ফেরদৌসের যেসব অশ্লীল ছবি তোলা হয়েছে, সব নেতার সামনে সব জায়গা থেকে তা ডিলিট করা (মুছে দেওয়া) ও ছিনিয়ে নেওয়া সব জিনিসপত্র তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল না মিটলে আমরা ছাত্রলীগ থেকে গণপদত্যাগ করব কি না, এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে উপস্থিত সবার উত্তর ছিল, ‘ইয়েস, ইয়েস ইয়েস।’ এ সময় সহসভাপতি মার্জানা আক্তার বলেন, ‘সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মিলিয়ে এখানে আমরা ২৫ জন আছি। আমরা একসঙ্গে পদত্যাগ করব, যদি বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক (তামান্না ও রাজিয়া) স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন।’ আরেক নেত্রী বলেন, ‘এমন নোংরা রাজনীতি আমরা করতে চাই না।’ সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বলেন, ‘প্রতিকার না পেলে আমরা সবাই গণহারে পদত্যাগ করব এবং ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আমরা আমাদের মতো করে সাহায্য করব।’

একপর্যায়ে সহসভাপতি মার্জানা আক্তার বলেন, ‘(কলেজ) প্রশাসন থেকে আমরা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি।’ তখন সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, ‘ইডেন কলেজে তামান্না ও রাজিয়া প্রশাসনের থেকেও অনেক বেশি স্ট্রং (শক্তিশালী)। তা নাহলে প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। ইডেন কলেজে আমরা তামান্না ও রাজিয়াকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম। বারবার অপরাধ করার পরও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তামান্না ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। এখন যদি সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা গণহারে পদত্যাগ করব। মেয়েদের কুপ্রস্তাব দেওয়া, চাঁদাবাজি এসব নোংরামি ইডেন কলেজে চলবে না। অন্য নেত্রীরা এ সময় সুস্মিতাকে সমর্থন করেন।’

এই সংবাদ সম্মেলন থেকে ইডেন কলেজের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের করা তদন্ত কমিটির প্রতিও অনাস্থা জানান ওই ২৫ নেত্রী। এই তদন্ত কমিটিকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন তাঁরা।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কল করা হলে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন কল কেটে দেন। সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা কল ধরেননি। চলতি মাসে তাঁদের বিরুদ্ধে কলেজের ছাত্রীনিবাসে সিটবাণিজ্য ও ছাত্রী নির্যাতনের একাধিক অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে এসেছে৷