হকার নেতাদের অভিযোগ, চাঁদার ভাগ যায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও অসাধু পুলিশ সদস্যদের পকেটে।
ঢাকার সূত্রাপুর থানার শ্যামবাজার থেকে বাহাদুরশাহ পার্ক হয়ে লক্ষ্মীবাজার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে এক হাজারের বেশি ছোট চৌকি বসানো, আছে বেশ কিছু রিকশাভ্যানও। এসব চৌকি ও রিকশাভ্যানে কাপড়চোপড়, প্রসাধনী, জুতা, বিছানার চাদর, মশারি, খেলনা, ফলমূল, শরবত, খাবার, গৃহস্থালি জিনিসপত্রসহ নানা ধরনের পণ্য সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। তবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে চার হাত আয়তনের একেকটি চৌকি বা রিকশাভ্যান বসাতে তাঁদের অগ্রিম দিতে হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর পণ্যের ধরন অনুযায়ী দৈনিক একজন হকারকে দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা।
কে বা কারা নেন এই টাকা, এমন প্রশ্নে লক্ষ্মীবাজারের একরামপুরের ফুটপাতের ফাস্ট ফুড বিক্রেতা সৈয়দ তানভীর জিলানি প্রথম আলোকে বলেন, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন ‘লাইনম্যান সরদার’ মো. ফিরোজের লোকজন। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে লাইনম্যান ও তাঁর সহযোগীরা মারধর করেন, মালামাল ফেলে দেন। ফিরোজ ও তাঁর দলবলের লোকজন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা বলে পরিচয় দেন।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য বলছে, শুধু এই এলাকা নয়, গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর ৬৫টি এলাকায় ফিরোজের মতো অন্তত ৩৮ জন লাইনম্যান সরদারের নেতৃত্বে ফুটপাতে হকার বসানো হয়। এসব হকারের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য নিযুক্ত আছেন দেড় শতাধিক লাইনম্যান। চাঁদা তোলার জন্য প্রত্যেক লাইনম্যানের সঙ্গে পাঁচ-সাতজন করে সহযোগী থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিক ও একশ্রেণির পুলিশ সদস্য মিলে লাইনম্যান সরদার ও লাইনম্যান নিয়োগ দেন। কোনো কোনো এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
কোনো কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজি করছেন, এমন অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।মোহা. শফিকুল ইসলাম, সদ্য বিদায়ী পুলিশ কমিশনার
ঢাকায় অন্তত তিন লাখ হকার রয়েছেন। এলাকাভেদে ও পণ্যের ধরন অনুযায়ী একজন হকারের কাছ থেকে দৈনিক ৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয় বলে হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির হিসাবে তিন লাখ হকারের কাছ থেকে দৈনিক গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে ফুটপাত থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে ৬ কোটি টাকা; মাসে ১৮০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি ও বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, অবৈধ হকার্স সংগঠন ও লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজেরা অসাধু পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশে চাঁদা তোলেন। বিভিন্ন থানা ও আদালতে মামলা হলেও তাঁরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান এম এ কাশেম।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের করা তালিকা অনুযায়ী, যেসব লাইনম্যান সরদার ও রাজনৈতিক নেতা চাঁদাবাজিতে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে ২২ জন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা, কাউন্সিলর, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগ নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের নেতা মারুফ আহমেদ, মতিঝিলের যুবলীগ নেতা সাগর আহমেদ, আওয়ামী লীগের নেতা বাচ্চু মিয়া, মতিঝিল থানা শ্রমিক লীগের নেতা নূর ইসলাম, ডিএসসিসি ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা মাসুম মোল্লা, জুরাইনের যুবলীগের নেতা মো. ইব্রাহীম ও নুরুল ইসলাম (শ্রম আদালত ঘোষিত অবৈধ ছিন্নমূল হকার্স লীগের নেতা)। এই সাতজনের লোকজন মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী ও জুরাইন এলাকার ফুটপাতে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে এসব নেতা অভিযোগ অস্বীকার করেন। কেউ কেউ দায় চাপান লাইনম্যান সরদারের ওপর। যেমন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ফুটপাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। তবে লাইনম্যান সরদার সাইফুল মোল্লা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন। একইভাবে আরেক কাউন্সিলর মাসুম মোল্লাও দাবি করেন, তাঁর এলাকা যাত্রাবাড়ীতে ফুটপাতে চাঁদাবাজি করেন তোরাব আলী (লাইনম্যানদের সরদার)।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন এবং হকারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও গুলিস্তান এলাকায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সাহাবুদ্দীন (দুলাল), যুবলীগের নেতা শেলি আহমেদ, বিমল চন্দ্র ও যুবলীগ কর্মী আবদুল হান্নান ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। জিপিওর সামনে চাঁদাবাজিতে জড়িত বিএনপি নেতা মো. হান্নান। নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন ডিএসসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আ স ম ফেরদৌস ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহীম ওরফে ইবু। ফার্মগেট এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান, অবিভক্ত ৯৯ (নতুন উত্তরের ২৭) ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম ও ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম এবং মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় শাহ আলী থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি সুমন ঢালী, ঢাকা মহানগর উত্তরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. ফারুক হোসেন, দারুসসালাম থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. ইসলাম ও সদস্য মো. হান্নান ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন।
তবে ক্ষমতাসীন দলের এসব নেতা চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এর মধ্যে দারুসসালামের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. ইসলামও দাবি করেন, অন্য ব্যক্তিরা চাঁদা তুলে তাঁর নাম ব্যবহার করছেন।
অবিভক্ত ৯৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম দাবি করেন, ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান। এ ছাড়া পুলিশও চাঁদার ভাগ নেয়।
তবে ফরিদুর রহমান খান দায় চাপান শাহ আলমের ওপর। তাঁর দাবি, শাহ আলম হকার সরদার। তিনি–ই চাঁদা তোলেন।
ডিএসসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আ স ম ফেরদৌসও নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতের চাঁদাবাজির দায় চাপান ওই এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ওপর। তাঁর দাবি, নিউমার্কেট থানার পুলিশ চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়।
ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা–পুলিশের ভাষ্য, এর সঙ্গে পুলিশ জড়িত নয়। তবে গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজির বিষয়ে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, এর কিছু তথ্য সত্য, কিছু মিথ্যা। ফুটপাতের চাঁদাবাজিতে পুলিশের সম্পৃক্ততা থাকলে সেখান থেকে যাতে বেরিয়ে আসা যায়, সামনের দিনগুলোতে সেই প্রচেষ্টা থাকবে।
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের একরামপুরের হকার সৈয়দ তানভীর জিলানি জানান, ফুটপাতে চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এ কারণে গত ২৯ জুলাই লাইনম্যান সরদার ফিরোজের নেতৃত্বে সাত–আটজন তাঁকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন। এ ব্যাপারে সূত্রাপুর থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেওয়া হয়নি। পরে তিনি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে।
তবে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মইনুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তানভীর জিলানি মামলা করতে থানায় আসেননি। তিনি বলেন, পুলিশ চাঁদার ভাগ নেয় না, বরং হকার ও তাঁদের লোকেরাই ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন।
সম্প্রতি ১৪ জন লাইনম্যান ও লাইনম্যান সরদারের নাম–ঠিকানা উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) বরাবর আবেদন করেছেন সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়া এলাকার ৩৭ জন হকার। ওই আবেদনে বলা হয়, গেন্ডারিয়া পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে থাকা উপপরিদর্শক (এসআই) ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেন চাঁদাবাজেরা।
গত জুলাইয়ে বংশাল ও কোতোয়ালি থানা হকার্স লীগের সভাপতি মো. সাকের ওই এলাকার লাইনম্যানদের বিরুদ্ধে তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। মো. সাকের সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত বলে দাবি করেন। তাঁরা বংশাল ও কোতোয়ালি এলাকায় ফুটপাতে হকার বসিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে চাঁদা নেন। ওই টাকার ভাগ যেত বংশালের কায়েতটুলি পুলিশ ফাঁড়িতেও। আইজিপির কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর ওই পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়।
ঢাকার মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম আজ শনিবার থেকে অবসরপূর্ব ছুটিতে যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকার ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ফুটপাত থেকে কোনো কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজি করছেন, এমন অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ ওঠা পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় হকার্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে করা একটি আবেদনও পেয়েছেন। সেটারও তদন্ত চলছে।
২০১৬ সালের বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের করা গবেষণার তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে হকারের সংখ্যা অন্তত তিন লাখ। ওই গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের এসব হকারের প্রত্যেকের কাছ থেকে দৈনিক গড়ে ১৯২ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এতে বছরে মোট ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়, যা ওই সময় দুই সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের চেয়ে বেশি ছিল।
ওই গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া ড. মো. শাহনেওয়াজ এখন বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফুটপাতে হকার বসায় যানজট হয়। বিষয়টি মাথায় নিয়ে তাঁরা গবেষণাটি করেছিলেন। সেই সূত্রে তখন হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার বিষয় উঠে আসে। তখন গবেষণায় ফুটপাতের হকারের সংখ্যা তিন লাখ পাওয়া গিয়েছিল, সেটা এখন আরও বেশি হবে।
ফুটপাত থেকে হকারদের পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন মো. শাহনেওয়াজ। তাঁর মতে, সরকার যদি হকারদের নির্ধারিত জায়গায় নির্ধারিত সময়ের জন্য বসা এবং ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে চাঁদাবাজি থাকবে না।