স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ: শাহবাগ থানা সরানো নিয়ে তিন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

শাহবাগ থানা না সরালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ (তৃতীয়) নির্মাণ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে থানার জন্য জমি দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
তবে দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ থানা স্থানান্তরের প্রস্তাব বাতিল করতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে টানাপোড়েন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের নির্মাণসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কাজ মূলত শাহবাগসংলগ্ন এলাকায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যের দৃশ্যমানতা ব্যাহত হবে। আবার এ প্রকল্পের এলাকায় শাহবাগ থানা হওয়ায় এটি স্থানান্তর করা না হলে প্রকল্পটির নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলাসহ সার্বিক কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে অসুবিধা হবে।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সবাইকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু বিষয়টি থমকে আছে চিঠিতেই, তাই কাজও থমকে আছে। কিন্তু যেভাবেই হোক এ প্রকল্পটি এই অর্থবছরেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
—আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় গত ১১ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এক চিঠি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের সুবিধার্থে প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তর থেকে শাহবাগ থানা সরানো জরুরি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শাহবাগ থানা স্থানান্তর করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন রমনা মৌজার সাকুরা রেস্টুরেন্টের স্থানে সরানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে (থানার) জমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে হস্তান্তরে ও দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষকে শাহবাগ থানা স্থানান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বারবার বলা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সবাইকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু বিষয়টি থমকে আছে চিঠিতেই, তাই কাজও থমকে আছে। কিন্তু যেভাবেই হোক এ প্রকল্পটি এই অর্থবছরেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য শিগগিরই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ শাহবাগ থানা স্থানান্তরের প্রস্তাব বাতিল করতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে টানাপোড়েন।

সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের চলমান অগ্রগতিবিষয়ক পর্যালোচনা সভায় বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের অগ্রগতি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শাহবাগ থানা দ্রুত স্থানান্তর না করা গেলে প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া সম্ভব হবে না নির্মাণ করা ফুলের দোকানের হস্তান্তর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার দাবিতে যখন দেশ উত্তাল, সেই সময় একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) লাখো জনতার সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। তর্জনী উঁচিয়ে বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ ইন্দিরা গান্ধী এ দেশ সফরকালে এই ময়দানেই ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁকে সংবর্ধনায় তৈরি করা হয়েছিল ইন্দিরা মঞ্চও।

নানা ঘটনাবহুল এ উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন। ইতিমধ্যে দেড় শ ফুট উঁচু কাচের তৈরি স্বাধীনতা স্তম্ভ ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি হয়েছে দুটি পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’–এর প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ ছিল ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এতে উদ্যানের উত্তর প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে শিখা চিরন্তন। এর সামনে থেকে একটি ‘অ্যাপ্রোচ প্লাজা’ করা হয়; যা গেছে স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত। স্তম্ভের পাশের জলাধার, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, জলাধারের দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন ও বাংলা একাডেমির সামনের অংশে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয় এ প্রথম পর্যায়েই।

প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে বহুল আলোচিত স্বাধীনতা স্তম্ভ। কাচের এ স্তম্ভের স্থাপত্য নকশা করেছিলেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরবানার স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। ‘এনডিই-নোভাম কনসোর্টিয়াম’ নামের বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান স্তম্ভটি নির্মাণ করে।

কাচের এ অভিনব স্তম্ভের নির্মাণ শুরু হয় ২০০৯ সালে। কাজ শেষ করতে সময় লেগে যায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত। খরচ হয় ১৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এই স্তম্ভ ছাড়াও প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে জলাধার সংস্কার, উদ্যানের চারপাশে স্টিলের বেড়া ও ছয়টি নতুন ফটক তৈরি করা হয়।