রাজধানীর গুলশান লেকের ১০ কাঠা বা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমি দখলকারী ব্যক্তি অনুরোধ করেছেন, তাঁকে যেন ‘ভূমিদস্যু’ বা ‘লেকখেকো’ বলা না হয়। প্রকাশ্যে জলাশয় বা লেক দখলের ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। তবু ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটেছে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনের বহুতল ভবনের পাশেই পারটেক্সের একটি কার্যালয়। সেই কার্যালয়ের পূর্ব পাশেই গুলশান লেক। নতুন টিন, বাঁশ আর নাইলনের নীল জাল দিয়ে লেকের অনেকখানি জায়গা ঘিরে ফেলেছেন সৈয়দ আহম্মেদ নামের এক ব্যক্তি। ঠিক এখানেই লেকের ওপর গুলশান–১ ও মহাখালী যাওয়া–আসার কালভার্ট।
গতকাল রোববার বেলা ১১টায় মহাখালী–গুলশানের ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘের দেওয়া জায়গাটিতে একটি টিনের দরজা আছে। তবে সেটি বন্ধ। টিনের ঘেরের ভেতর উঁচু একটি সাইনবোর্ডে লেখা, ‘আইনগত বিজ্ঞপ্তি’। তাতে আরও লেখা, গুলশান মৌজার আবাসিক এলাকায় সিটি জরিপ দাগ নং ৮৮২১, জমির পরিমাণ ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ (১০ কাঠা)। এই জমিতে কোনো নির্মাণকাজে ২০১৮ সালে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। ভেতরে লোক দেখা গেল, কিন্তু ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া গেল না।
ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও প্রাকৃতিক জলাশয়বিষয়ক আইন অনুযায়ী জলাশয়ের স্থানে কোনো স্থাপনা করার সুযোগ নেই। ওই ব্যক্তি (সৈয়দ আহম্মেদ) যদি জমির মালিক হন, মালিক হওয়ার পরও যদি কোনো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে থাকেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারেন। কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, শিগগির লোক পাঠিয়ে কাগজপত্র যাচাই করা হবে।রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম
ওই জায়গার পূর্ব পাশেই একটি নার্সারি। নার্সারির ভেতর ঢুকে কথা হয় মালিকের সঙ্গে। মালিক দুজন, কামরুজ্জামান (শিপু) ও লিটন; তাঁরা বন্ধু। দুই বন্ধুর এই নার্সারির নাম ‘নতুন বাংলাদেশ’। ৫ আগস্টের আগে এই নার্সারির মালিক ছিলেন অন্যরা। কামরুজ্জামান বলেন, ‘নার্সারির নামে এখানে মাদকের ব্যবসা চলত। সরকার পড়ে যাওয়ার পরই আমরা ওদের (আগের মালিক) বলেছি, নার্সারিতে আর না ঢুকতে। এখন আমরাই নার্সারি দেখাশোনা করি।’ তাঁরা দাবি করলেন, গুলশান সোসাইটির মৌখিক অনুমতি নিয়েই তাঁরা নার্সারি চালাচ্ছেন। দুজনেই মহাখালীর বাসিন্দা।
তাঁদের মধ্যে লিটন একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। লিটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাশের জায়গাটি যাঁরা দখল করেছেন, তাঁদের চিনি না। আগে কখনো দেখিনি। শুনেছি লোকটি বিদেশে ছিলেন।’
গুলশান লেকের ওই অংশের পাশের রাস্তা দিয়ে বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, স্কুটি চলাচল করছে। এসব যানবাহনে থাকা অনেকেরই চোখ আটকে যাচ্ছে হঠাৎ তৈরি হওয়া টিনের বেড়ায়।
নার্সারির নামে এখানে মাদকের ব্যবসা চলত। সরকার পড়ে যাওয়ার পরই আমরা ওদের (আগের মালিক) বলেছি, নার্সারিতে আর না ঢুকতে। এখন আমরাই নার্সারি দেখাশোনা করি।কামরুজ্জামান
লিটন এই প্রতিবেদককে নিয়ে গেলেন বেড়া দেওয়া স্থানে। বেশ কয়েকবার শব্দ করার পর এক কিশোর দরজা খুলে দিল। ভেতরে ভাঙা ইট ও সিমেন্টের বেশ কয়েকটি বস্তা। একটি ছোট টিনের ঘর, সেখানে খাটিয়ায় বসা তত্ত্বাবধায়ক। নাম মো. নূরুল ইসলাম। জানালেন, সাড়ে সাত বছর সিঙ্গাপুরে ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।
নূরুল ইসলাম বললেন, জায়গাটির মালিক সৈয়দ আহম্মেদ। সৈয়দ আহম্মেদ সম্পর্কে তাঁর ভাই। বাসা উত্তরায়। সৈয়দ আহম্মেদ রাশিয়ায় ছিলেন।
লেকের জায়গার কথা তুলতেই নূরুল ইসলাম একটি ‘অনুরোধপত্র’ এই প্রতিবেদকের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তাতে লেখা, কেউ যেন সৈয়দ আহম্মেদকে ‘ভূমিদস্যু’ বা ‘লেকখেকো’ না বলেন।
পাশের জায়গাটি যাঁরা দখল করেছেন, তাঁদের চিনি না। আগে কখনো দেখিনি। শুনেছি লোকটি বিদেশে ছিলেন।লিটন
তত্ত্বাবধায়ক নূরুল ইসলাম দাবি করেন, ২০০১ সালে জায়গাটি সৈয়দ আহম্মেদ এক ব্যক্তির কাছ থেকে কেনেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঠিকাদার ২০১৭–১৮ সালে গুলশান লেক সংস্কারের সময় তাঁদের জমি খনন করে লেকে রূপান্তর করে। তাঁরা মামলা করেন। ২০১৮ সালে হাইকোর্ট উন্নয়নকাজে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এ–সম্পর্কিত সব কাগজপত্র রাজউক ভবনে জমা দেওয়া আছে। জমির মালিক এখনো সৈয়দ আহম্মেদ।
এত দিন আপনারা কোথায় ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নূরুল ইসলাম বলেন, মামলা–মোকদ্দমায় সময় চলে গেছে। হাতে টাকাপয়সা তেমন ছিল না। এখন সময় হয়েছে।
এ ব্যাপারে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম প্রধান আলোকে বলেন, ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও প্রাকৃতিক জলাশয়বিষয়ক আইন অনুযায়ী জলাশয়ের স্থানে কোনো স্থাপনা করার সুযোগ নেই। ওই ব্যক্তি (সৈয়দ আহম্মেদ) যদি জমির মালিক হন, মালিক হওয়ার পরও যদি কোনো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে থাকেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারেন। কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, শিগগির লোক পাঠিয়ে কাগজপত্র যাচাই করা হবে।