তিন মন্ত্রীও পারলেন না

পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। তা-ও ভয়াবহ একটি অগ্নিকাণ্ডের পর। নিমতলীর সেই আগুনে মারা যান অন্তত ১২৪ জন। কথা ছিল, একটি রাসায়নিক শিল্পপার্ক হবে, সেখানে রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা তাঁদের গুদাম সরিয়ে নেবেন।  

সেই উদ্যোগের পর ১৩টি বছর পেরিয়ে গেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুজন মন্ত্রীর মেয়াদ শেষ হয়েছে—দিলীপ বড়ুয়া ও আমির হোসেন আমু। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের মেয়াদও শেষের পথে। মন্ত্রণালয়টিতে আটজন সচিব বদলেছেন। কিন্তু রাসায়নিক শিল্পপার্ক এখনো তৈরি হয়নি। শিল্পপার্ক করার আগে রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিতে ২০১৯ সালে অস্থায়ী গুদাম তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সেই গুদামও এখনো পুরো তৈরি হয়নি।

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীর আগুনে মারা মৃত্যু ১২৪
রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের শিল্পপার্কে নিতে হবে জোর করে। যেমনটা নেওয়া হয়েছে ট্যানারির মালিকদের
সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু

এর আগে ২০০৬ সালে পুরান ঢাকা থেকে প্লাস্টিকের কারখানা সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক সই হয়। সেই প্লাস্টিক শিল্পনগরের জমি অধিগ্রহণই এখনো হয়নি।

রাসায়নিক শিল্পপার্ক করার যে উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম, তা পরে ফলোআপ করা হয়নি। কায়েমি স্বার্থবাদীরা পুরান ঢাকা ছেড়ে যেতে চায় না
দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক শিল্পমন্ত্রী

রাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগর প্রকল্প নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এরপর আরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের এই মৃত্যু ও দুর্ভোগের কারণ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে না পারা। বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ২৪ জনের মৃত্যুর পর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, সিদ্দিকবাজারের ঘটনা রাসায়নিক থেকে না হলেও পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকি থেকে যাওয়ার জন্য দায়ী সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহির অভাব ও জীবনরক্ষার প্রকল্পে অগ্রাধিকার না দেওয়া।

জায়গা নির্ধারণের পর সেটি নিয়ে আপত্তি, নতুন জায়গা খোঁজা, জমি অধিগ্রহণজনিত সমস্যা, করোনা ও নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্পটিতে দেরি হয়েছে
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন

২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের শেষ পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিক শিল্পপার্ক করার যে উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম, তা পরে ফলোআপ করা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, কায়েমি স্বার্থবাদীরা পুরান ঢাকা ছেড়ে যেতে চায় না।

দিলীপ বড়ুয়ার সময়ে রাসায়নিক শিল্পপার্কের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তিনি প্রকল্পটির প্রস্তাবই (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল বা ডিপিপি) তৈরি করে যেতে পারেননি।

২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার আগুনে মৃত্যু হয় ৭১ জনের

শিল্প মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পুরোনো কর্মকর্তারা জানান, তখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে ১৯টি বহুতল ভবন হবে। সেসব ভবনে রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের জায়গা দেওয়া হবে। অবশ্য এ প্রস্তাবে বেঁকে বসেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের যুক্তি ছিল, বহুতল ভবন ঝুঁকি আরও বাড়াবে। তাঁরা ভবনের বদলে জমি দেওয়ার দাবি করেছিলেন। শিল্প মন্ত্রণালয় পরে ৫০ একর জমিতে ব্যবসায়ীদের ছোট ছোট প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দিলীপ বড়ুয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছরেও জরুরি একটি প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করতে না পারা খুবই অযৌক্তিক। এটা তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে হওয়া উচিত ছিল। হয়নি, কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও জবাবদিহি ছিল না।

আমির হোসেন আমুর পাঁচ বছর

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন আমির হোসেন আমু। তিনি দায়িত্বে ছিলেন ২০১৯ সালের শুরু পর্যন্ত। তাঁর মেয়াদের প্রায় পুরোটা লেগে যায় রাসায়নিক শিল্পপার্কের ডিপিপি তৈরি ও প্রকল্প অনুমোদন করাতে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয় ২০২ কোটি টাকা।

আমির হোসেন আমু গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়াদে রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। এর জন্য টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়। একটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ১৩ বছর সময়কে অনেক বেশি মনে হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা তো হয়।’

আমির হোসেন আমু আরও বলেন, রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের শিল্পপার্কে নিতে হবে জোর করে। যেমনটা নেওয়া হয়েছে ট্যানারির মালিকদের।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা যে ‘গো ধরে’ বসেছিলেন, সে সময় তাঁদের বাধ্য করার দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতদ্বৈততা নিরসন করে একটি প্রকল্প চূড়ান্ত করতে সাড়ে চার বছরের মতো লেগে যাওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি হয়তো অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। সরকারের নানা কাজ থাকে। পুরান ঢাকার মানুষের জীবনরক্ষার প্রকল্প অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়ক নিরাপদ করা, নৌদুর্ঘটনা রোধ, খাদ্য নিরাপদ করা—এগুলোও জীবনরক্ষার প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্প অগ্রাধিকার তালিকায় ১ নম্বরে থাকা উচিত।  

নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের চার বছর

বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন দায়িত্ব নেন ২০১৯ সালের শুরুতে। ওই বছর ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিক শিল্পপার্ক নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে তখন শিল্পপার্ক করার জায়গা কেরানীগঞ্জ থেকে সরিয়ে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নেওয়া হয়। জমি ৫০ একর থেকে বাড়িয়ে ৩১০ একর করা হয়। সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প ব্যয়, ২০২ কোটি টাকা থেকে হয় ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এ প্রকল্প অনুমোদন পেতে আর সময় লাগেনি।

২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এটি অনুমোদন দেয়। এরপর চার বছরের বেশি সময় পেরিয়েছে। রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্পের অগ্রগতি হলো শুধু প্রথম পর্যায়ের মাটি ভরাটের কাজ। সেটাও হয়েছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনও প্রকল্পটি শেষ করে যেতে পারছেন না। এটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে ১ হাজার ৮৪৩টি শিল্প প্লট করা হবে।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিক শিল্পপার্ক করার প্রকল্পটিকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমি পুরান ঢাকার ছেলে, নারিন্দার ছেলে।’ শিল্পমন্ত্রী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথাও বলেন। তাঁর দাবি, জায়গা নির্ধারণের পর সেটি নিয়ে আপত্তি, নতুন জায়গা খোঁজা, জমি অধিগ্রহণজনিত সমস্যা, করোনা ও নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্পটিতে দেরি হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বিসিক না পারলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ঠিকই পেরেছে। তারা ২০১৩ সালে কাজ শুরু করে ইতিমধ্যে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ শুরু করেছে। পাঁচটিতে শিল্পকারখানা করা হচ্ছে। তিনটিতে কিছু কারখানা উৎপাদনও শুরু করেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মানুষের জীবন যে মূল্যহীন, সেটা শুধু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রমাণিত হয় না, এত বছর পরে সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার মাধ্যমেও প্রমাণিত হলো। এটা সদিচ্ছা ও প্রত্যয়হীনতা এবং মানুষকে নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থতার প্রমাণ।’

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক শিল্পপার্ক স্থাপনের কাজ তেমন এগোয়নি। এখনো মাটি ভরাটের কাজ চলছে

রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এই শিল্পপার্কের ৩১০ একর জমিতে ৬ দশমিক ২ মিটার (১৮ দশমিক ৬ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত মাটি ভরাট করা হয়েছিল। ২০২২ সালের মার্চে ধরা পড়ে যে সেখানে ১ মিটার (৩ ফুট) মাটির কোনো হদিস নেই। পরে এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে কী এসেছিল, তা জানতে গত বৃহস্পতিবার বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমানের দপ্তরে গেলে তিনি সংশ্লিষ্ট শাখায় কথা বলতে বলেন। অবশ্য অন্য কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাসায়নিক শিল্প পার্ক প্রকল্পের সময় যে আটজন সচিব দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের দুজন এবং প্রকল্পের সাবেক একজন পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অস্থায়ী গুদামও শেষ হয়নি

২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার আগুনের পর রাসায়নিক শিল্পপার্ক করার তোড়জোড় যেমন শুরু হয়, তেমনি দুটি অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। একটি টঙ্গীতে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) ৬ একর জমিতে। অন্যটি ঢাকার শ্যামপুরে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে। দুটি অস্থায়ী গুদাম তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৬৮ কোটি টাকা।

তখনকার শিল্পসচিব মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শিল্পপার্ক তৈরি করতে ২০২২ সাল পর্যন্ত লাগবে। এ কারণেই অস্থায়ী গুদাম।

গাজীপুরের টঙ্গীতে ৫৩টি গুদামঘরের মধ্যে ৩১টির অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে। তবে ব্যবহারের উপযোগী হয়নি

সরেজমিনে গত শুক্রবার দেখা যায়, উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গুদামের কাজ শেষ। তবে সেটি উদ্বোধন হয়নি। আর টঙ্গীর কাজ ৪০ শতাংশ বাকি। টঙ্গীর প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক খন্দকার জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাকি কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও প্রায় এক বছর।

দুটি অস্থায়ী গুদামে ১০৭টি রাসায়নিকের গুদামের স্থান হবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটুকু জায়গায় কিছুই হবে না। কারণ, পুরান ঢাকায় ২০ হাজারের মতো রাসায়নিকের দোকান আছে। রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিক্যাল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আছেন ১ হাজার ৬০০ জন। সংগঠনটির উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আসলে দরকার রাসায়নিক শিল্পপার্ক। সেই প্রকল্পের খুব মন্থরগতি। আবার একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তোড়জোড় শুরু হবে।

প্লাস্টিকশিল্প নগর বহুদূর

প্লাস্টিকশিল্প নগর প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। এ জন্য মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানে ৫০ একর জায়গা নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় আট বছর পার হলেও জমি অধিগ্রহণই করতে পারেনি বিসিক।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে ২১৮ কোটি টাকা জমা দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের বিরোধিতার কারণে জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় মৌজা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবার সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিসিক।

পুরান ঢাকায় ঝুঁকি

পুরান ঢাকা বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) প্রকাশিত ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা হতো। এর মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবসা হতো সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, মিটফোর্ড রোড, বাংলাবাজার, নবাবপুর, সোয়ারীঘাট ও মতিঝিলে। রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা জানান, এখন মিটফোর্ড, ইমামগঞ্জ, চকবাজার, তাঁতীবাজার, গেন্ডারিয়া, সিদ্দিকবাজার, আলুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা হয়। আর প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবসা হয় চকবাজার, কামালবাগ, লালবাগ, পোস্তা, উর্দু রোড প্রভৃতি এলাকায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর একমত হয় যে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক ব্যবসা সরিয়ে নিতে না পারলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু পুরান ঢাকায় এখনো রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে কোনো বাধা ছাড়া। গতকাল শনিবার গিয়ে দেখা যায়, পুরান ঢাকার ওয়ারীর হাটখোলা এলাকার নজরুল ইসলাম সড়কে রাসেল সেন্টার নামের একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনের চতুর্থ তলা পর্যন্ত রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম রয়েছে। বাকি ছয়তলায় মানুষের বাস। ভ্রাম্যমাণ আদালত গত আগস্টে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পাওয়ায় ভবনটির কয়েকটি গুদাম সিলগালা করে। এখন সেখানে গুদাম খুলে আবার ব্যবসা চলছে। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকির বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

‘এটা ব্যর্থতার নজির’

১৯১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানে ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ১৪৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত আইনকানুনে আমূল পরিবর্তন আনে এবং কারখানা নিরাপদ করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের উদ্যোগ ও চাপে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের ১৩ বছর পরও রাসায়নিকের ব্যবসা সরানো যায়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতে নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ কারণে সেখানে দ্রুত কাজ হয়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকায় মানুষের জীবন সংকটের প্রশ্নে কাজ হচ্ছে ধীরগতিতে।

জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সুশাসন থাকা দেশগুলোতে দুর্ঘটনা রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। এরপরও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা থেকে তারা শিক্ষা নেয়। তিনি বলেন, ২০১০ সালে যখন জানা গেল পুরান ঢাকায় ব্যাপক দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা হয়, তখন তিন মাসের মধ্যে সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল। ১৩ বছরেও সেটা করতে না পারা ব্যর্থতার নজির।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ ও সংবাদদাতা, গাজীপুর]