সাহ্‌রিতে এমন ভিড় দেখা যায় রাজধানীর ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয়। রোববার রাতে
সাহ্‌রিতে এমন ভিড় দেখা যায় রাজধানীর ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয়। রোববার রাতে

সাহ্‌রি খেতে ঘরের বাইরে

শুক্রবার রাজধানীর বাড্ডা থেকে তরুণ দম্পতি তামান্না রহমান ও সজল ইসলাম ধানমন্ডিতে তাঁদের মামার বাসায় এসেছিলেন ইফতারের দাওয়াতে। রাতে ঠিক হলো সবাই মিলে বাইরে যাবেন সাহ্‌রি খেতে।

রাত আড়াইটার দিকে তাঁরা পৌঁছে গেলেন মিরপুর–১২ নম্বর এলাকার আবেশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। সেটির ভেতরে–বাইরে জমজমাট। বাইরে গাড়ি আর বাইকের ভিড়। কেউ পরিবারসহ, কেউবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সাহ্‌রি খেতে এসেছেন। তামান্না বলেন, ‘এ বছর এবারই প্রথম সাহ্‌রি খেতে বাইরে এলাম। এতে একটু স্বাদ বদল হয়, আর পরিবারের সবাই মিলে একটা ভালো সময় কাটে।’

পবিত্র রমজান মাসে রাজধানীসহ সারা দেশেই প্রায় সব হোটেল–রেস্তোরাঁয় ইফতারের আয়োজন থাকে বেশ। রেস্তোরাঁয় বসে ইফতার করার রেওয়াজও পুরোনো। তবে এক দশক আগে থেকে মধ্যরাতে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় সাহ্‌রির আয়োজন দেখা যায়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সাহ্‌রি আয়োজনও দেখা গেছে। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় এবং এর পরের দুই বছর ঘরের বাইরে সাহ্‌রি খাওয়ার প্রবণতা কম ছিল।

ব্যাংকার ও ভ্রমণবিষয়ক লেখক ফখরুল আবেদিন যেমন বললেন, ‘আগে সাহ্‌রি খেতে যাওয়ার একটা জমজমাট ব্যাপার ছিল, কোভিডের পর সেটা অনেক কম। এবার হয়তো অনেকেই খেতে যাচ্ছেন, তবে ফেসবুকে ছবি বা চেক–ইন কম দিচ্ছেন।’

এবার রমজান মাসের শুরু থেকেই অবশ্য অনেক রেস্তোরাঁয় সাহ্‌রির প্রস্তুতি দেখা গেছে। ফেসবুকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার হোটেল–রেস্তোরাঁর সাহ্‌রির সময়কার খাবারের মেন্যু ও দরদামে বিশেষ সুবিধার বিজ্ঞাপন বেশ চোখে পড়ে।

ঢাকায় সাহ্‌রির জনপ্রিয় গন্তব্যের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা এলাকার রেস্তোরাঁগুলো। বংশালের আল–রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, ঠাটারি বাজার ও কোর্টকাচারি এলাকার স্টার হোটেল অ্যান্ড কাবাব সাহ্‌রির খাবারে জনপ্রিয়তা এখনো ধরে রেখেছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা স্টারের সব শাখাতেই সাহ্‌রির আয়োজন রয়েছে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও শৌখিন আলোকচিত্রী ফারুখ আহমেদ বলেন, ‘স্টার ও আল–রাজ্জাকের পাশাপাশি পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের রেস্তোরাঁগুলোয় সাহ্‌রির আয়োজন পুরোদমে চলছে। এখানকার কাবাবের দোকানগুলোও খোলা থাকে সব সময়। পুরান ঢাকার ঘরোয়া, আল ইসলাম, ইসলামিয়া, বুখারি, ক্যাফে ইউসুফ, লালবাগের রয়েল, হোটেল জান্নাতে সাহ্‌রির সময় ভিড় লেগেই থাকে।’

আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার সোহাগ ফরাজি বলেন, ‘এবার সাহ্‌রির সময়ে খাবারের চাহিদা যথেষ্ট বেশি। প্রতিদিনই আমাদের এখানে মানুষ খেতে আসেন, তবে বৃহস্পতি–শুক্র–শনিবার ও সরকারি ছুটির দিনের আগের রাতে ভিড় বেশি হয়।’

অভিনেতা সুমন পাটোয়ারী চলতি রমজান মাসে তিন দিন গিয়েছিলেন সাহ্‌রি খেতে। সুমন বলেন, ‘সাহ্‌রি তো আর কেউ একলা খেতে যায় না। তাই বন্ধুদের নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। পুরান ঢাকা, গুলশান–লিংক রোডে টেরাকোটা টেলস ও শেফ’স টেবিলে গিয়েছি।’ ঘরের বাইরে সাহ্‌রি করার এই ধারা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য—নাগরিক জীবনে আনন্দময় সময় কাটানোর প্রয়োজন আছে। রাতে রাস্তা ফাঁকা থাকে, সেটিও উপভোগ্য।

দূরদূরান্ত থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যেমন সাহ্‌রি খেতে মানুষ আসে, তেমনি ঢাকা থেকেও কিছুটা দূরের গন্তব্যে যান অনেকে। তরুণদের সংগঠন জেসিআই বাংলাদেশের ঢাকা পাইওনিয়ার চ্যাপটারের একটি দল ২৫ মার্চ রাতে গিয়েছিল মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। এই সংগঠনের সদস্য মোহতারিমা রহমান বললেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ঢাকার বাইরে যেতে এবং ইলিশ মাছ দিয়ে সাহ্‌রি করতে। আমরা মোট ১২ জন গিয়েছিলাম। মাওয়া ঘাটে অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে, তবে পদ্মা নদীর পাড়ে যে খোলা খাবারের দোকানগুলো আছে, আমরা সেগুলোর একটা বেছে নিয়েছিলাম। কারণ, এগুলোর খাবারের স্বাদ অন্য রকম।’

ঢাকার প্রায় সব পাঁচ তারকা ও বিশেষায়িত হোটেলে ইফতার–নৈশভোজের আয়োজন রয়েছে প্রতিদিন। সাহ্‌রির আয়োজন মূলত বৃহস্পতি–শুক্রবার ও সরকারি ছুটির আগের রাতে থাকছে। পাঁচ তারকা হোটেলের সব কটাতেই ব্যুফে সাহ্‌রির ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ডে ১টি কিনলে ৩টি বিনা মূল্যে (বাই ওয়ান গেট থ্রি) পাওয়ার সুবিধাও আছে।

বিভিন্ন রেস্তোরাঁর প্রচলিত খাবারই থাকে সাহ্‌রির আয়োজনে। ভাত, পোলাও, গরু–খাসি–মুরগির মাংস, ডাল, মাছ পাওয়া যায় বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয়। পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যুফে সাহ্‌রিতে থাকে অসংখ্য পদ। গুলশান–বনানী, ধানমন্ডির বিশেষায়িত রেস্তোরাঁগুলোয় ব্যুফে বা তাদের নির্দিষ্ট মেন্যুতে পাওয়া যায় সাহ্‌রির খাবার।

সাহ্‌রিতে বাইরের খাবার ঘরে এনে খাওয়ারও একটা চল দেখা যাচ্ছে। অনেকেই খাবার সরবরাহের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সাহ্‌রির ফরমাশ দিয়ে থাকেন। খাবার সরবরাহের অ্যাপ ফুডপ্যান্ডার হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ও পাবলিক রিলেশন জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘সাহ্‌রির সময় অনলাইনে খাবার অর্ডার দেওয়ার হার বাড়ছে। আমাদের যেসব পার্টনার রেস্তোরাঁ সাহ্‌রিতে খোলা থাকে, তারা আমাদের অ্যাপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছে।’