একাংশ চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়নি জেলা প্রশাসন। আরেকাংশ বুঝিয়ে দিলেও খালি পড়ে থাকায় বেদখল।
রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানার জন্য সরকার পঞ্চাশের দশকে ২১৮ দশমিক ১১ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। ৪ দশমিক ৭ একর ছাড়া বাকি জমি ঢাকা জেলা প্রশাসন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়। এই ৪ দশমিক ৭ একর জমির মূল মালিকেরা তখন মামলা করেন।
আদালত তাঁদের পুনর্বাসন করে সেই জমি দখল নেওয়ার নির্দেশনা দেন। তখন সরকার পাশে আরও দুই একর জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ পুনর্বাসন না করায় সেই জমিও বেদখল হয়ে যায়। এভাবে চার দশকের বেশি সময় ধরে চিড়িয়াখানার মোট ৬ দশমিক ৭ একর জমি বেদখল হয়ে আছে।
চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানার জমিসংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে করণীয় ঠিক করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সঙ্গে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তাতে সাড়া দেননি।
জানা যায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের জন্য জাতীয় চিড়িয়াখানার জমির ৬ দশমিক ৬৫ একর পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) এবং ২০ দশমিক ১৩ একর কেন্দ্রীয় মুরগি খামারকে দেওয়া হয়। বেদখল বাদ দিলে এখন প্রায় ১৮৭ একর জমি চিড়িয়াখানার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জেলা প্রশাসন থেকে বুঝে না পাওয়া ৪ দশমিক ৭ একর জমির অবস্থান চিড়িয়াখানা সীমানাপ্রাচীর–সংলগ্ন মিরপুর নবাবের বাগ এলাকায়। সেই জমিতে শতাধিক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে।
জমি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৫৪ সালে চিড়িয়াখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। প্রায় পাঁচ একর জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তাঁদের দাবি, সরকার তাঁদের জমি অধিগ্রহণ করলেও টাকা দেয়নি। তখন পরিবার ছিল প্রায় দেড় শ। এখন পরিবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার শ। একই সঙ্গে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক বহুতল ভবন। এখন চিড়িয়াখানা এই জমি নিতে চাইলে জমি ও বহুতল ভবনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এ জমির মধ্যে আবদুর রহমানের ৯ শতাংশ জমি রয়েছে। সেই জমিতে দোতলা ভবন করেছেন তিনি। আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার আমাদের পুনর্বাসনও করে না, ক্ষতিপূরণও দেয় না। এভাবে আর কত দিন? তাই বাধ্য হয়ে জমিতে ভবন করেছি। সরকার হয় আমাদের জমি দিয়ে দিক, নইলে পুনর্বাসন করুক। আমরা খাজনা দেব।’
চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মালিকদের জমির টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন আমাদের সেই জমি বুঝিয়ে দেয়নি।’
আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ৪ দশমিক ৭ একর জমির বাসিন্দাদের পুনর্বাসনে মিরপুর–১ নম্বরের গুদারাঘাট এলাকায় সত্তরের দশকে ২ একর জমি অধিগ্রহণ করে চিড়িয়াখানাকে দেয় জেলা প্রশাসন। সেই জমি ভরাটও করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পুনর্বাসন না করায় ১৯৯০ সালের দিকে তা বেদখল হয়ে যায়। গড়ে উঠে লাল মাঠ বস্তি।
সরেজমিন দেখা যায়, লাল মাঠ বস্তিতে আধা পাকা ঘর ও কিছু দোকান গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পাঁচ–ছয়জন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এ বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা ভাড়া আদায় করেন।
২০১৬ সালে একবার লাল মাঠ বস্তি দখলমুক্ত করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সেখানে গেলে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ওপর হামলা চালান স্থানীয় মো. জালাল হোসেন তালুকদার (বাবুল), রইস (উকিল) ও জাহিদের নেতৃত্বে ৩৫–৪০ ব্যক্তি। এ ঘটনায় শাহ আলী থানায় একটি মামলা হয়।
ওই ঘটনায় অভিযুক্ত জালাল দাবি করেন, ‘১৯৭৬ সালে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ একটি এলএ কেস ফেলেছিল। কিন্তু চূড়ান্ত নোটিশ, জমির মূল্য নির্ধারণ, কত টাকা দেবে—তার কিছুই হয়নি। জমি আমাদের নামে রয়ে গেছে।’
২০১৬ সালে ওই ঘটনার পর জমি উদ্ধার তৎপরতায় জড়িত বেশ কয়েক কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান। এরপর যাঁরা আসেন, তাঁরা আর জমি উদ্ধারের বিষয়ে তেমন এগোননি।
চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, ‘জেলা প্রশাসন আমাদের কাছে এই দুই একর জমি হস্তান্তর করেছে। তবে এখনো সীমানা নির্ধারণ ও প্রাচীর নির্মাণ করা হয়নি। আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় এগোব।’