বনানীতে ২৮ তলা ভবন

সরকারি জমিতে পাঁচ তারকা হোটেল

জমির মালিক সিটি করপোরেশন। সেখানে ১৪ তলার চুক্তি করে ২৮ তলা ভবন বানিয়ে ভোগদখল করছে বোরাক রিয়েল এস্টেট।

বনানী শেরাটন হোটেল ভবন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে সিটি করপোরেশনের ৬০ কাঠা জায়গায় ২৮ তলা ভবন বানিয়ে একাই ভোগদখল করছে বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড। সেখানে তৈরি করা হয়েছে পাঁচ তারকা হোটেল।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কর্তৃপক্ষ বলছে, বোরাক রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে চুক্তি ছিল ১৪ তলা ভবন নির্মাণের। যার ৩০ শতাংশ পাবে সিটি করপোরেশন, বাকিটা বোরাক। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী তাদের ভাগের সম্পদের মূল্য প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। কিন্তু সে হিস্যা গত এক দশকেও বুঝে পায়নি সিটি করপোরেশন। উল্টা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ১৪ তলার স্থলে ২৮ তলা ভবন নির্মাণ করে পুরোটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বোরাক।

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে বোরাক রিয়াল এস্টেটের সঙ্গে করপোরেশনের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বনানী কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশে ও বনানী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উত্তর পাশে সিটি করপোরেশনের জমিতে ‘বনানী সুপার মার্কেট কাম হাউজিং কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করা হবে। ভবনের ৩০ শতাংশ পাবে সিটি করপোরেশন, ৭০ শতাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। অসম এই চুক্তি নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়। সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়।

সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর বনানীর এই সম্পত্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভাগে পড়েছে। উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বনানীর মতো এলাকায় করপোরেশনের জমিতে ভবন নির্মাণে যে অসম চুক্তি হয়েছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখন কিছু সুবিধাভোগী চক্র এই অসম চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বনানীর ৪৪ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে করপোরেশনের ৬০ কাঠা জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ কাঠা জমিতে আগেই করপোরেশনের তিনতলা মার্কেট ছিল। মার্কেটের সামনে প্রধান সড়ক লাগোয়া প্রায় ১৬ কাঠা খালি জমি ছিল। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল কেবল ৪৪ কাঠা জমিতে ভবন নির্মাণের জন্য। সামনের ১৬ কাঠা থাকবে খোলা জায়গা। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে পরে সামনের খালি ১৬ কাঠা জমিও প্রকল্পে যুক্ত করে ৬০ কাঠা জমিতে ১৪ তলা ভবন নির্মাণের চুক্তি করা হয়।

কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোরাক সামনের ১৬ কাঠা খালি জমিতে ২৮ তলা ভবন নির্মাণ করে। চুক্তি ভঙ্গ করে ২৮ তলা ভবন না করতে বোরাককে চিঠি দিয়ে কাজ করতে বারণ করে সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, করপোরেশন কেবল চিঠি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। কাজ বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

যেসব কর্মকর্তা ওই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি জমি দখলের সুযোগ করে দিয়েছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। কারণ, তাঁদের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই সেখানে ভবন নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না।
ইফতেখারুজ্জামান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক

অনুমোদন ছাড়াই ২৮ তলা

উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ২০০৬ সালের মে মাসে প্রথম চুক্তি হয়েছিল। ১৩ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০৭ সালের জুলাইয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করে করপোরেশনকে তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।

চুক্তির ৮ মাসের মাথায় সেখানে ৩০ তলা ফাউন্ডেশন রেখে ১৪ তলা ভবন এবং একটির পরিবর্তে তিনটি বেজমেন্ট তৈরির আবেদন করে বোরাক। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের জুনে সিটি করপোরেশন সংশোধিত চুক্তি করে। এরপর ১৩ তলার পরিবর্তে ১৪ তলা ভবন নির্মাণে সংশোধিত চুক্তি হয়। এর ২৭ দিনের মাথায় আবার ১৪ তলার ওপর আরও ১৬ তলা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করে বোরাক। কিন্তু অনুমোদনের অপেক্ষা না করে নির্মাণকাজও চালিয়ে যায় তারা।

এ–সংক্রান্ত ঢাকা উত্তর সিটির একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সেখানে ১৪ তলার ওপরও ভবন নির্মাণকাজ চলছে। চুক্তি ভঙ্গ করে এভাবে কাজ করতে নিষেধ করা হলেও বোরাক কর্তৃপক্ষ সেটা শোনেনি। উল্টো ৩০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন চেয়ে আবার আবেদন করে। পরে সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এরই মধ্যে ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ—দুই ভাগ হয়ে যায়। তখন এই ভবনের মালিকানা পায় উত্তর সিটি।

‘আলোচনা করে যতটুকু আদায় করা যায়, ততটুকুই করপোরেশনের লাভ।’ তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের শেয়ার আরও বাড়াতে বোরাকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেটারই একটা প্রস্তাব তাঁরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
আতিকুল ইসলাম, উত্তর সিটির মেয়র

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ সব নথি পর্যালোচনা করে ৩০ তলা ভবন নির্মাণের বিষয়ে আপত্তি জানায়। পরে বিষয়টি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ায়। মন্ত্রণালয় থেকে তখন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে তৎকালীন মেয়র (বর্তমানে প্রয়াত) আনিসুল হক ও প্যানেল মেয়র (প্রয়াত) ওসমান গনি একাধিক কমিটি করেন, তবে কোনো সুরাহা হয়নি। এরই মধ্যে ২৮ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যায়। সর্বশেষ বিষয়টি নিয়ে বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম একটি কমিটি করে দেন। ওই কমিটি ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

বোরাক রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সিটি করপোরেশন থেকে ৩০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। এখন সমস্যা হচ্ছে মালিকানার ভাগাভাগি নিয়ে।

তবে নূর আলীর এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন উত্তর সিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাষ্য, একটি আবেদন করেই ৩০ তলা ভবনের কাজ শুরু করে দেয় বোরাক। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই সেখানে ২৮ তলা ও ৩টি বেজমেন্ট করা হয়। এরপর ওই ভবনে পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটন চালু করা হয়। জমির মালিক উত্তর সিটি হলেও পুরো ভবন ব্যবসায়ী নূর আলীর নিয়ন্ত্রণে।

এ বিষয়ে নূর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তর সিটি করপোরেশন নিজেরা এখনো তাদের জায়গা বুঝে নেয়নি। করপোরেশনে কিছু দুষ্টু লোক আছে, যারা কারও অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাদের কারণে এই জটিলতা।’

বোরাকের কৃপায় উত্তর সিটি

সিটি করপোরশনের সূত্র জানায়, এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে নিজের জমিতে নির্মিত হাজার কোটি টাকার এই সম্পদের কতটুকু সিটি করপোরেশন পাবে; সেটা অনেকটা বোরাকের কৃপার ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে।

এ জটিলতা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি ২০২২ সালের জানুয়ারিতে একটি কমিটি করে। ওই কমিটির কাছে বোরাক কর্তৃপক্ষ নতুন প্রস্তাব দেয়। তাতে বলা হয়, অনুমোদন ছাড়া নির্মিত ভবনের, অর্থাৎ ১৫ থেকে ২৮ তলায় তারা ৪০ শতাংশ মালিকানা সিটি করপোরেশনকে দিতে চায়। এ প্রস্তাব সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ ফোরাম বোর্ড সভায় অনুমোদন পেয়েছে।

বোরাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলী প্রথম আলোকে বলেন, দুই পক্ষের স্বার্থেই তিনি ৪০ শতাংশ দিতে রাজি হয়েছেন।

এ বিষয়ে উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের ভাষ্য, ‘আলোচনা করে যতটুকু আদায় করা যায়, ততটুকুই করপোরেশনের লাভ।’ তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের শেয়ার আরও বাড়াতে বোরাকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেটারই একটা প্রস্তাব তাঁরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।

উচ্চতার জটিলতা রেখে ভাগাভাগি

সব সংস্থা থেকে অনুমোদন নিয়েই ভবন নির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেছেন নূর আলী। কিন্তু বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অনুমোদনহীন অতিরিক্ত উচ্চতার ভবনটি অপসারণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) অনুরোধ জানিয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর আরেকটি স্মারকে মন্ত্রণালয় থেকে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও বলা হয়েছে, উড়োজাহাজের আকাশপথের কারণে ওই প্লটে ২০১ ফুটের বেশি উচ্চতার ভবন করার সুযোগ নেই। সুতরাং উচ্চতার অতিরিক্ত অংশটুকু দ্রুত অপসারণ করতে হবে।

রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের চিঠির ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, আমরা দেখছি।’

সরেজমিনে যা দেখা গেল

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৬ কাঠার খালি জমিতে অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত ২৮ তলা ভবনে রয়েছে পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটন। ভবনের ২৮ তলায় সুইমিংপুল, ২৭ তলায় ব্যায়ামাগার। ১৫ তলায় রেস্টুরেন্ট ও ১১ তলায় রয়েছে বলরুম।

বাকি ৪৪ কাঠার মধ্যে, যেখানে আগেই সিটি করপোরশনের ভবন ছিল। সে ভবন বর্ধিত করে ১৪ তলা করা হয়েছে। সেখানে ৩ তলা পর্যন্ত দোকানপাট রয়েছে। চারতলায় গিয়ে দেখা যায় টাইলস লাগানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাকি রয়েছে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর দুজন নিরাপত্তাকর্মী এসে এই প্রতিবেদককে চলে যেতে বলেন। পরে ওই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মী বলেন, ওই ভবনের পুরো কাজ শেষ হয়নি।

এ বিষয়ে নূর আলীর দাবি, সেখানে আগে থেকে থাকা দোকানদারেরা কাজ করতে দিচ্ছেন না। এ কারণে ধীরে ধীরে কাজ করা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন তো এখনো কোনো মালিকানা পায়নি, এর কারণ জানতে চাইলে নূর আলী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের পেছনে ঘুরছি, তারা নিতে চায় না। অন্যরা সব মেরে দিচ্ছে।’

সিটি করপোরেশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব কর্মকর্তা ওই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি জমি দখলের সুযোগ করে দিয়েছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। কারণ, তাঁদের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই সেখানে ভবন নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, তাঁরা যথাসময়ে পদক্ষেপ নেননি। জনগণের দাবির মুখে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত দেশে আছে। এই ভবনের বিষয়েও পদক্ষেপ নিয়ে আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত।