নামে অনেক চেনা, অথচ চোখের দেখা হয়নি তার সঙ্গে বেশি ভাগ লোকেরই। কৃষ্ণবরণ দেহ। যেন মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল—এমনই গুচ্ছ গুচ্ছ চিরসবুজ পাতার ঘন সন্নিবেশ শাখায় শাখায়। গাছটির নাম ‘তমাল’। নাম তো জানাশোনাই, কিন্তু সহজে তাকে চোখে পড়ে না। ‘কাজির গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নাই’—এই প্রবচনের অর্থগত দিকটি খুব মিলে যায় তমালগাছের সঙ্গে।
বাংলা কাব্যে, সাহিত্যে তমালের দেখা মেলে প্রায়ই। রবি ঠাকুর লিখেছেন—‘কোন তমালের কাননতলে মধ্যদিনের তাপে/ বনচ্ছায়ায় শিরায় শিরায় তোমার সুর কাঁপে’। চৈত্র-বৈশাখের নিদাঘ দুপুরে তমালতলার প্রগাঢ় ছায়া, তার পাতা দুলিয়ে দিয়ে বয়ে আসা ঝিরঝিরে বাতাসের স্পর্শ শুধু শরীরই জুড়ায় না, প্রাণেও প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। আর ওই তমালতরুর শাখায় বা তলায় বসে যে মোহন বাঁশিতে হৃদয় আকুল করা সুর তোলে, সে আর কেউ নয়, যশোদা নন্দন গোপাল।
তমালতরুর মতোই তার গাত্রবর্ণ। মাথাভরা তেমনই ঘন কেশের চূড়া। তার বাঁশির সুর ‘কানের ভেতর দিয়া মরমে পসিয়া’ আকুল করে তোলে রাধিকার হিয়া।
বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে যেমন বাঁশির সুর, দারুণ অভিসার আর অন্তহীন বিরহবেদনা জুড়ে আছে, তেমনি আছে কদম্ব, তাল, তমালতরুর সমাহার। সেই যে বিদ্যাপতি, বরিষনমুখর দিনে রাধার মুখ দিয়ে চিরকালের বিরহবেদনার কথা বলিয়েছিলেন কালজয়ী পঙ্ক্তিতে—‘এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভর বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর’।
তিনি কৃষ্ণহারা রাধার শোকতাপের মর্মস্পর্শী বয়ান দিতে গিয়ে লিখেছেন—‘না পোড়াইও রাধাঅজ্ঞ না ভাসাইও জলে/ মরিলে তুলিয়া রেখো তমালের ডালে/ সেই তো তমালতরু কৃষ্ণবর্ণ হয়/ অবিরত তনু মোর তাহে জনু রয়’।
শুধু মধ্যযুগের পদকর্তারাই নন, বাংলার চিরশ্যামল নিসর্গ শোভার স্তুতি গাইতে গিয়ে আধুনিক কালের কবিরাও তমালতরুকে উপেক্ষা করতে পারেননি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় তমালতরুর ছায়াপাত থাকবে না, তা তো ভাবাই যায় না। তিনি ‘বাংলার মুখ’ কবিতায় লিখেছেন—‘এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ’। আবার পাকিস্তানি জামানায় স্বদেশের সৌন্দর্যের স্তুতি গাইতে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসান তাঁর খুব বিখ্যাত কবিতা ‘আমার পূর্ব বাংলা’য় এভাবে লিখেছেন—‘আমার পূর্ব-বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ/ অন্ধকারের তমাল/ অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।’
এত যার স্তবস্তুতি, বাস্তবে সেই তমালগাছ দেশে সুলভ দর্শন নয়। প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে গজিয়ে ওঠা তমাল খুবই কম। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইতে লিখেছেন—‘বাংলাদেশে, বিশেষত পূর্ব বাংলায় তমাল বস্তুতই দুষ্প্রাপ্য। দেবস্থান, মন্দির, আখড়া, এমনই বিশিষ্ট পরিবেশের বইরে প্রকৃতির নিজস্ব অঙ্গনে কোথাও তমাল আমার চোখে পড়েনি।’ তিনি ঢাকা শহরে একটিমাত্র সুদৃশ্য তমালতরুর দেখা পেয়েছিলেন পুরান ঢাকার জয়কালী মন্দির রোডের রাম-সীতা আশ্রমে।
সেই তমালের সাক্ষাৎ পেতে গত রোববার জয়কালী রোডে গিয়ে দেখা গেল আশ্রমটি বদলে এখন ‘রাম-সীতা মন্দির’ রূপান্তরিত হয়েছে। গাছটিও নেই। মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি গণেশ ঘোষ জানালেন, সংস্কার করে মন্দিরের নতুন ভবন হয়েছে। সে সময় বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে, তমালও তার মধ্যে ছিল। ফলে ঢাকার দেবালয়ে আপাতত তমালতরুর সাক্ষাৎ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশ্য তমালদের দেখা মিলতে পারে জনারণ্যে। মুসলিম-হিন্দুনির্বিশেষে ‘তমাল’ নাম রয়েছে অনেকেরই।
উদ্ভিদবিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোতে তমালের পরিচিতি ছোট বা মাঝারি আকারে বৃক্ষ হিসেবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এর কাণ্ড কালো বা কালচে রঙের। বাকল মূলত মসৃণ, কখনো কখনো গাঁট বা কাঁটা থাকতে পারে। শাখা প্রশাখাগুলো আঁকাবাঁকা। পাতা গাঢ় সবুজ, গড়ন অনেকটা পানপাতার মতো। লম্বায় ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বসন্তে সাদা ফুল ফোটে। এর পাপড়ি খসখসে। গ্রীষ্মে ফল হয়। দেখতে ছোট আকারের গাবের মতো। নিচের দিকটা সুচালো। পাকা ফল কমলা ও হলুদের কাছাকাছি রঙের।
ভেতরে তিন থেকে চারটি লম্বাটে বীজ থাকে। এ ফল খাওয়ার অনুপযুক্ত। তবে ঔষধি গুণ আছে। অনেকে একে ‘বুনোগাব’ও বলে থাকেন। তমাল খুব ধীরে বড় হয়। কাঠ লালচে হলুদ। বেশ শক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডায়স্পাইরাস মন্টানা কার্ডিফলিয়া’। তমাল, বুনোগাব ছাড়াও বাংলায় ‘মহেষকান্ড’ও ‘নীলধজ’ বলেও স্বল্প পরিচিত নাম রয়েছে।
দ্বিজেন শর্মা উল্লেখ করেছেন, চিরসবুজ পাতার এত ঘন সন্নিবেশময় গাছ বেশ দুর্লভ। পাতা ও ফল মাছের জন্য বিষাক্ত। তমালের আদি নিবাস মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায়। বীজ থেকে সহজেই তমালের চারা জন্মে। হয়তো ধী গতির বৃদ্ধির কারণেই বনায়নের ক্ষেত্রে তমালের ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। ফলে নামের খ্যাতি থাকলেও তমালতরু যাচ্ছে বিপন্নের পথে।