ঈদের সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোর প্রায় ফাঁকা। জটিল অসুস্থতা না থাকলে ঈদের আগে রোগীরা সাধারণত বাড়ি ফিরে যান
ঈদের সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোর প্রায় ফাঁকা। জটিল অসুস্থতা না থাকলে ঈদের আগে রোগীরা সাধারণত বাড়ি ফিরে যান

দেখা থেকে লেখা

আনন্দের ঈদে নিরানন্দের মানুষেরা যেমন থাকেন

পবিত্র ঈদুল ফিতরের সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন মোহাম্মদ জাহিদ। তাঁর চোখের নিচে অনিদ্রার ছাপ। জাহিদ তাঁর চাচা মোহর আলীকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচার করতে হবে। গতকাল মাঝরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর থেকে মোহাম্মদ জাহিদ এভাবে বসে অপেক্ষা করছেন, হঠাৎ কখন প্রয়োজন হয় তাঁকে! সঙ্গে আর কেউ নেই।

ঈদের দিন কিছু খেয়েছেন কি না জানতে চাইলে জাহিদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘হাসপাতাল থেকে খাবার দিয়েছে রোগীর জন্য। অপারেশন না হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারছি না, আসলে কী অবস্থা।...আমিও এখান থেকে উঠতে পারতিছি না। খাওয়া মাথায় উঠছে।’

জাহিদ জানালেন, গত রাতে টাঙ্গাইলের সখীপুরে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন তাঁর চাচা মোহর আলী (৫৫)। মাথায় আঘাত পেয়েছেন তিনি।

গুরুতর আহত চাচার অস্ত্রোপচারের জন্য জাহিদের এই অপেক্ষা। আপাতত বাইরের কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারছে না জাহিদকে। তাঁর জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়ে রইল আজীবনের জন্য।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবেশমুখে বসে আছেন নারী নিরাপত্তা সদস্য। রোগীর নাম না বললে তিনি কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবেন না। এর মধ্যে অবশ্য প্রতিবেদকের পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল দুপুরের খাবারের ট্রলি। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও হাসপাতাল থেকে দুপুরে দেওয়া হয়েছে বিশেষ খাবার। দুপুরের খাবার হিসেবে পোলাও, মুরগির মাংস, ডিম ও আপেল দেওয়া হয়েছে। সকালে সাধারণ নাশতার সঙ্গে ছিল সেমাই।

হাসপাতালের ওয়ার্ডের অনেক রোগী। ওয়ার্ডে খাবারের ট্রলি ঢোকার পর স্যালাইন, ওষুধ, ময়লা মেঝে, ভ্যাপসা গরম—সব ছাপিয়ে পাওয়া গেল খাবারের ঘ্রাণ। রোগীদের সঙ্গে থাকা শিশুরা একটু বেশি আগ্রহী ঈদের খাবার নিয়ে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে ওরা ভীষণ ক্লান্ত!

রাজবাড়ীর আমির হোসেন ছেলে আরাফাতকে (৫) নিয়ে পাটি পেতে বসেছেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির তলার সামান্য ফাঁকা জয়গাটায়। ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলেন হাসপাতাল থেকে দেওয়া পোলাও। রোগী কে জানতে চাইলে বললেন, তাঁর স্ত্রী একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু স্ত্রীর শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আমির জানালেন, সমস্যা হচ্ছে এই পাঁচ বছরের আরাফাতকে নিয়ে। সে আর এখন হাসপাতালে থাকতে চায় না। এখন রোগীর চাপ একটু কম, তাই সিঁড়ির তলায় জায়গা পেয়ে ছেলেকে নিয়ে আপাতত বসেছেন এখানে। শিশু আরাফাত কিছু খাবার মুখে দিতে দিতে কিছু ছড়িয়ে ফেলছিল। ওর বাবা একটু ধমকে উঠলেন ছেলেকে।

আমির প্রথম আলোকে জানালেন, হাসপাতাল থেকে রোগীর খাবার তিন বেলা দেয়। কিন্তু স্বজনদের তো কিনে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ঢাকায় পরিচিতও কেউ নেই তাদের। তাই ঈদের মতো বছরের একটি বিশেষ উৎসবও তাদের কাছে আলাদা কিছু আনেনি, খাবারের পাতে হাসপাতালের দেওয়া খাবারটুকু ছাড়া।

ঈদের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক, রোগী এবং খাবার নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের সময় রোগীর চাপ কিছুটা কমে যায়। খুব জটিল না হলে রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনেরা চলে যেতে চান। ছুটির জন্য চিকিৎসক কম থাকে, কিন্তু সে সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে কম নয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিঁড়ির নিচে পাটি বিছিয়ে বসেছেন আমির হোসেন। ছেলে আরাফাত হোসেনকে (৫) খাইয়ে দিচ্ছেন তিনি

তবে হাসপাতালেও ঈদের আমেজ আনার চেষ্টা থাকে কারও কারও। নেহাত এক পদের খাবার হয়তো তৈরি করতে পারে সেই আমেজ। দুপুরের দিকে হাসপাতালের ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে এলেন এক নারী। এক হাতে পাটি, আরেক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। তাঁর পিছু পিছু এলেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি। ওয়ার্ডের দরজার পাশে পাটি পেতে সেই মানুষের পাতে গরম খিচুড়ি তুলে দিলেন তিনি। তাঁদের বাড়ি কেরানীগঞ্জে। তাঁদের মেয়ে সদ্য মা হয়েছেন। আছেন এই ওয়ার্ডে। কিন্তু ঈদের সকালে খিচুড়ি না খেলে নাকি ঈদই হয় না। তাই নিজে মেয়ে-নাতিকে দেখবেন কথা দিয়ে স্ত্রীকে ভোরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। তিনি গরম খিচুড়ি রান্না করে কেরানীগঞ্জ থেকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। একটু যেন লজ্জা পেয়েই প্রথম আলোকে বললেন, ‘...মানুষটা খাইতে চাইছে। এইটুক কষ্ট তো করাই লাগে।’

কেরাণীগঞ্জ থেকে স্ত্রীর রান্না করে আনা খিচুড়ি খাচ্ছেন তিনি

ঈদের দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়লা মেঝেতে বসেও খিচুড়ি খাওয়ার সেই দৃশ্য দেখে ফিরে আসার সময় দেখা হলো বাড্ডার বাসিন্দা নুরুল হোসেন আর তাঁর ছেলের সঙ্গে। নুরুল হোসেনের পা ভেঙেছে। পায়ে প্লাস্টার এখনো আছে। তবে এখন বাড়ি ফিরলে বিশেষ অসুবিধা নেই, তাই ফিরে যাচ্ছেন আজই। তাঁদের চোখে–মুখে ঈদের দিন বাড়ি ফেরার আনন্দের ঝিলিক।

তবে আজকের দিনেও যাদের হাসপাতালে আসতে হচ্ছে কিংবা থাকতে হচ্ছে— তাঁদের অবস্থা টাঙ্গাইল থেকে আসা জাহিদ ও তাঁর চাচার মতো। এ দিনটি তাদের কাছে থাকবে মনখারাপের স্মৃতি হয়ে।