ঢাকা ও আশপাশের ৬৫ শতাংশ এলাকা ভরাট করে আবাসন। মাটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব এলাকা ভূমিকম্পের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
ঢাকা মহানগরে ভবন নির্মাণ অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। ভবনটি ভূমিকম্পসহনীয় করে নির্মিত হলো কি না, সে বিষয়ে কোনো তদারকি নেই তাদের। যে নকশার মাধ্যমে ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, সেটি জমা নেয় না তারা। ফলে নতুন কোনো ভবনও নিরাপদ কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভরাট করে গড়ে তোলা ভবনগুলো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, নরম মাটি ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়ায়।
রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় মহানগর এলাকার মাটি পরীক্ষার ফলাফল এবং সংস্থাটির ভবন নির্মাণ অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় ঢাকায় তুরস্কের মতো ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশের ৬৫ শতাংশ এলাকার ভবন ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। মূলত বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি–আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন স্থাপনা নির্মাণে গুণগত মানোন্নয়নে ২০১৫ সালে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প চালু হয়। আগামী অক্টোবরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। প্রায় ৫৩৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকার দিচ্ছে ৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা, বাকি অর্থ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
■ রাজউক এলাকায় স্থাপনা ২১ লাখের বেশি
■ এর মধ্যে কংক্রিটের স্থাপনা অন্তত ৫ লাখ
■ ইটের স্থাপনা প্রায় সাড়ে ৮ লাখ
■ ভরাট করা জমিতে ভবন ২-৩ লাখ
■ শুধু তুরাগ নদের আশপাশে ভরাট জমি প্রায় ৭ হাজার একর
■ রাজউকের সমীক্ষার আওতায় ৩২৫২ ভবন
■ অপসারণ করতে হবে ৪২ ভবন
এই প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালী প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের আওতাধীন এলাকার ১ হাজার ৮২৫টি স্থান থেকে মাটি নিয়ে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষাগারে আরও ১০ রকমের পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বালু দিয়ে ভরাট এলাকা ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
দেশে দুর্যোগঝুঁকি কমাতে প্রথম জাতীয় পরিকল্পনা করা হয় ২০১০ সালে, পরে ২০১৯ সালে সেটি পরিমার্জন করা হয়। ২০১০ ও ২০১৯ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকায় সব ভবনে ও কাঠামোর ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু ১২ বছরেও সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তারা করেনি।
তবে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবন এবং রানা প্লাজা ধসের পর প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে জরিপ হয়েছে। কিন্তু আবাসিক ভবন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভবন জরিপ করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২০৭টি হাসপাতাল, ৩৬টি থানা ও ৩০৪টি অন্যান্য ভবন রয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, প্রায় ৬০টি প্রশ্নের তালিকা ধরে ৩ হাজার ২৫২টি ভবনের ‘র্যাপিড ভিজ্যুয়াল অ্যাসেসমেন্ট’ করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, তুরস্কের মতো ভূমিকম্প হলে একটি ভবনও টিকবে না। এরপর এসব ভবনের মধ্যে ৫৭৯টির ‘প্রিলিমিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ (পিইএ) করা হয়। এতে দেখা যায়, ৪২টি ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ওই ৪২ ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ভবন ভাঙতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করে তাঁদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভবন জরিপ শেষ হলে বেসরকারি ভবনের জরিপ শুরু হবে। শিগগিরই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ শুরু করা হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা বোর্ডের ভবন রয়েছে। এ ছাড়া সমীক্ষায় ১৮৭টি ভবনের ‘ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ করে সেগুলো মজবুত (রেক্টিফাই) করতে বলা হয়েছে।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের কোনো চিঠি তিনি পাননি। তবে রাজউক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এলে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।
ঢাকায় কোন তীব্রতার ভূমিকম্পে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা জানতে প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসিক ভবন নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তাই ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ঢাকায় ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদনের সময় শুধু ভবনের স্থাপত্য নকশা জমা নেয় তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থাপত্য নকশার মাধ্যমে ভবন দেখতে কেমন হবে, অর্থাৎ অবয়ব নির্ধারণ করা হয়। আর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হয় কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) নকশার মাধ্যমে। ভবনগুলো যাতে ভূমিকম্পসহনীয় করে নির্মিত হয়, সেটি রাজউককে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এখনো এ ব্যাপারে তারা উদাসীন।
রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, এখন ভবন নির্মাণ অনুমোদনের সময় কাঠামোগত নকশা দেখে না রাজউক। ভূমিকম্পসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী মাস থেকে রাজউকের অঞ্চল-৩ (মিরপুর) ও ৪-এ (মহাখালী) ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার সময় স্থাপত্য নকশা, কাঠামোগত নকশার পাশাপাশি মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক ও অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত নকশা জমা নেওয়া হবে। আগামী মে থেকে পদ্ধতিটি পুরো রাজউক এলাকায় চালু করা হবে।
রাজউকের একাধিক ইমারত পরিদর্শক বলেন, নির্ধারিত জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, মূলত তাঁরা সেটিই দেখেন। নির্মাণের পর ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত না ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি বিবেচনা করা হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইমারত পরিদর্শক বলেন, রাজউকে জমা দেওয়া স্থাপত্য নকশায় একজন স্থপতি ও একজন প্রকৌশলীর (পুরকৌশল) সই থাকে। এই নকশা অনুমোদন দেওয়ার পর বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে কাঠামোগত নকশা তৈরি ও তার বাস্তবায়ন এই দুজনের নৈতিক দায়িত্ব। এটি না মানলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে রাজউকের মামলা করার সুযোগ আছে। কিন্তু কাঠামোগত নকশা না মানায় কোনো প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কখনো মামলা হয়েছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত রাজউকের এক জরিপের তথ্যমতে, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবীর ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন; রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন; ধানমন্ডির প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা বলেন, ভবন নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার পর প্রতিটি ধাপে কারিগরি ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রত্যয়ন নেওয়ার কথা রাজউকের। কিন্তু তারা নেয় না। তাই রাজউকের অনুমোদিত ভবন ভূমিকম্পসহনীয় বলার সুযোগ নেই।
ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। বড় হচ্ছে ঢাকা নগর। এ অবস্থায় বৈধ-অবৈধভাবে ঢাকা শহরের চারপাশের জলাভূমি, বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও নিচু জমি ভরাট করে নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প হচ্ছে।
রাজউকের নথি অনুযায়ী, শুধু তুরাগ নদের আশপাশে ১০টি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় সাত হাজার একর নিচু জমি ভরাট করেছে। এসব জমি প্লট আকারে বিক্রিও করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভরাট করা জমির মাটি নরম হয়। এটি ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়ায়। নরম মাটিতে নিরাপদ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উন্নত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হয়। প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে টেকসই ভবন করার উদ্যোগ না নিলে ভূমিকম্পে এসব ভবন মাটির নিচে দেবে বা হেলে যেতে পারে।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, মধুপুর গড়ের দক্ষিণ প্রান্তে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগর। এই নগরের ৩৫ শতাংশ মাটি ২০ লাখ বছর আগের শক্ত ও লালমাটি। বাকি ৬৫ শতাংশ নিচু এলাকা বিধায় অপ্রকৌশলগত ভাবে মাটি ভরাট করে নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নরম মাটি ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়ায়। তবে মাটি শক্ত হলেই যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম হবে সেটি বলা যাবে না। কারণ দূরবর্তী ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে মাটির এক হাজার থেকে তিন হাজার মিটার নিচের শিলা স্তর ভেদ করে বোমা বিস্ফোরণের মতো কাদা-বালুর উদ্গিরণ হতে পারে। কোনভবন ঝুঁকিপূর্ণ আর কোনটি ঝুঁকিমুক্ত সেটি চিহ্নিত করার দায়িত্ব রাজউকের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূতাত্ত্বিক ও প্রকৌশলীদের মধ্যে সমন্বয় করে রাজউকের কাজটি করা উচিত। তবে এক্ষেত্রে রাজউকের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে।
রাজউকের এলাকা ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। এতে ছোট-বড় ভবন ও স্থাপনা আছে ২১ লাখের বেশি। এর মধ্যে নরম ও শক্ত মাটিতে কী পরিমাণ স্থাপনা আছে, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ওই ৬৫ শতাংশ এলাকায় মূল নগরের মতো ঘরবাড়ি হয়নি বলে মনে করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নরম মাটির এলাকার মধ্যে পূর্বাচল, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প, ঝিলমিলসহ রাজধানীর আশপাশের আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এসব এলাকা এখনো পুরোদমে নগরায়ণ হয়নি। ফলে ৬৫ শতাংশ এলাকায় এখন ২-৩ লাখ ভবন থাকতে পারে।
তবে অধ্যাপক মেহেদী বলেন, আগামী ১০ বছরে ওই ৬৫ শতাংশ এলাকায় আরও অন্তত ১০ লাখ ভবন হবে। নির্মাণের সময় ‘সিমেন্ট গ্রাউটিং’–এর মাধ্যমে জমি শক্ত করে সঠিক নকশা মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। না হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা সম্ভব হবে না।